‘নৌকা উল্টায় দিয়ে মাইরা ফালা’

দালাল রফিক (সাদা শার্ট)

‘সাগরে যখন ভাসতে থাকি, তখন মোবাইল ভিজে যাওয়ায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। ওয়াকিটকির মাধ্যমে নৌকার একজন লিবিয়ায় দালালের সঙ্গে কথা বলে। সেখান থেকে দালাল বলে, নৌকা উল্টায় দিয়ে মাইরা ফালা। নৌকার চালককে হাজার অনুরোধ করে, হাতে পায়ে ধরে, তা করা থেকে বিরত থাকতে বলি। তারপর তারা আর নৌকা উল্টায়নি।’

লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে সাগরে নৌকা (বোট) নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠিক এভাবেই বয়ান করলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইদ্রিস জমাদ্দার। শুক্রবার (২১ জুন) বিকালে ১৭ জন বাংলাদেশির সঙ্গে দেশে ফিরেছেন তিনি। এর আগে টানা তিন সপ্তাহ তিউনিশিয়ার সাগরে একটি জলযানে ভেসে ছিলেন তারা।

ফেরার পরে ইদ্রিস জানান, লিবিয়ায় ছিলেন তিনি। যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই লিবিয়ার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনারের কাজ করে দিন যাচ্ছিল তার। হঠাৎ এক দালাল চক্রের ফাঁদে পড়ে যান। তারা খুব সহজে বড় জাহাজে করে ইতালি যাওয়ার লোভ দেখায় এবং নিশ্চয়তা দেয় যে, খুব কম সময়ের মধ্যে ইতালি পৌঁছোনো যাবে। কিন্তু যখন তারা পরিস্থিতি বুঝতে পারেন, ততক্ষণে সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

লিবিয়া থেকে ইতালি যাত্রার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইদ্রিস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দালাল রফিকুল ইসলাম সেলিমের মাধ্যমে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথ হয়। খরচ হিসেবে ৩ লাখ করে টাকা নিয়েছে সবার কাছ থেকে। দুই মাস আমাদের লিবিয়ার ‘‘গেম ঘরে’’ আটকায়ে রাখে। খাওয়া দিতো না ঠিক মতো, পানি চাইলে টয়লেটের পানি এনে খাওয়াইতো। আমরা সেখানে মানবেতর জীবন যাপন করছি আর কী। কোনোদিন না খেয়েও দিন কাটসে। এরপর একদিন আমাদের ইতালি পাঠানোর ট্রলারে উঠায় দিয়ে ছবি তুলে রাখে। যাওয়ার সময় বলে দেয়- কোনও কষ্ট হবে না, তোমরা ইতালি পৌঁছে যাবা।’

তিনি আরও বলেন, ‘মে মাসের ২৭ তারিখ আমাদের ৩০-৩৫ জন লোককে একটি কাঠের নৌকায় তুলে দেয় তারা। আমরা সেই নৌকায় উঠতে চাই নাই। আমাদের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে, মারধর করে, জোর করে নৌকায় তুলে দেয় দালালারা। সমুদ্রের অবস্থা তখন খুব খারাপ ছিল। তিনদিন ধরে এক জায়গায় বসে থাকার পর দালাল রফিকরে ওয়াকিটকি দিয়ে জানানো হয় যে, বোট খারাপ হয়ে আটকায় আছি। এর মধ্যে তেল-ও শেষ। ওই পাশ থেকে দালাল বলে- ইতালির জন্য গেসস, অইদিকে যা, আর নাহলে বোট উল্টায় মাইরা ফালা। না মারলে, তুই এদিক আসলে আমি তোরে মাইরা ফেলমু।’              

দেশে ফিরে আসা নোয়াখালীর রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি দালাল রফিকের পাচারের শিকার। গত বছরের জুনে লিবিয়া যান। লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে রফিক ৩ লাখ টাকা নেয়। এরপর ৪ মাস লিবিয়ার গেম ঘরে বন্দি করে রাখে। কাল বা পরশু বা তারপর দিন এরকম করে দিনের পর দিন ঘুরাতে থাকে। পরে ইতালি যেতে না চাইলেও মারধর করেছে।

জানা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা যায়, তিউনিসিয়ার সাগরে ভাসতে থাকা ৬৪ জন বাংলাদেশির মধ্যে শুক্রবার দেশে ফিরে আসা এই ১৭ জনের বেশির ভাগই বয়সে তরুণ। এরা হলেন- মাদারীপুরের মোহাম্মদ লাদেন মাতব্বর (২০), রাসেল মাতব্বর (৩০), রাজীব মাতব্বর (২০), জুয়েল শাহজালাল (৩৪), আজাদ রহমান (২৭), পিয়ার আলী (২৯), আকমন মাতব্বর (২০), মীর আজিজুল ইসলাম (৩৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আবু বকর সিদ্দিক (২৩), শাহেজুল খাদু (২৫), ইদ্রিস জমাদ্দার (২৪), নিয়ামত শিকদার (১৮), নোয়াখালীর রফিকুল ইসলাম (২৮), চাঁদপুরের শফিকুল ইসলাম (৩৩), শরীয়তপুরের রাকিব হোসেন (২১), মৌলভীবাজারের জিল্লুর রহমান (৩৫) ও সুনামগঞ্জের শিপন আহমেদ (২১)।  দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরের তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে একাধিক সংস্থা। সেখানে তারা লিবিয়ার দালাল রফিক, তার সহযোগী বুলেট, মমিন এবং রাসেলের নাম উল্লেখ করেছেন। জিজ্ঞাসবাদ শেষে এবং ভেরিফিকেশন রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট থানা থেকে আসার পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের।  

 সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপ প্রবেশে করেছে ১০ বছরে ১ লাখ বাংলাদেশি!

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্যে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ। গত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজার ৯০৬ জন। নিখোঁজ হয়েছেন ১২ হাজারের বেশি মানুষ।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী- ২০১৩ সালে ৬৩৬ জন, ২০১৪ সালে ৭৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৫৫৫ জন, ২০১৬ সালে ১৪৮৫ জন, ২০১৭ সালে ৭৯৫ জন, ২০১৮ সালে ৬৭৭ জনসহ এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১২ হাজার ৫৩৯ জন।

ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান বিষয়ক দফতর ইউরোস্ট্যাট-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন। এর মধ্যে ২০১৬ সালে ১৭ হাজার ২১৫ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলে ১১ হাজার ৭১৫টি আবেদন বাতিল করা হয়।

ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইতালিতে প্রবেশের হার দিন দিন বাড়ছে।