পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ঘটনা তিব্বতেও, মাশুল দিচ্ছে নেপাল

তিব্বতের টাকলাকোট শহর

জুন মাসে বাংলাদেশে নির্মাণাধীন পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেভাবে একজন চীনা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে, তার দিনকয়েক আগেই প্রায় অবিকল একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে তিব্বতের টাকলাকোট শহরে।

সেখানে অভিবাসী একজন নেপালি শ্রমিকের চালানো হামলায় একজন চীনা মহিলা নাগরিক নিহত হন, যার জেরে সেখানে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এখনও ওই ঘটনার রেশ কাটেনি এবং সরাসরি এর প্রভাব পড়েছে কাঠমান্ডু ও বেজিংয়ের সম্পর্কেও।  

তবে পায়রার ঘটনায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশ যেভাবে কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পেরেছে, টাকলাকোটের ক্ষেত্রে নেপাল কিন্তু তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

পরিণামে চীনা কর্তৃপক্ষ নেপাল থেকে এই গ্রীষ্ম মৌসুমে নেপালি শ্রমিকদের তিব্বতে কাজ করতে যাওয়ার ওপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শুধু তাই নয়, টাকলাকোটে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত এক ব্যক্তিকে চীনা কর্তৃপক্ষ নেপালের ভেতরে ঢুকে হিলসা শহর থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।

গ্রেফতার ওই নেপালি নাগরিকের নাম তীর্থ খাদেড়া। তিনি হিলসার কাছেই সারকেগাড় গ্রামের বাসিন্দা।

এদিকে, ভারতের সরকারি সূত্রগুলো জানাচ্ছে,এই মৌসুমে নেপাল থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের সন্ধানে ভারতে আসার ঘটনা অনেকটাই বেড়ে গেছে। চীনের দরজা আপাতত বন্ধ থাকার কারণেই গত দুমাসে নেপাল থেকে প্রায় বাড়তি ১০ শতাংশ লোক ভারতে কাজ করতে আসছেন বলে তারা ধারণা করছেন।

নেপাল ও চীনের মধ্যে একটি চুক্তি অনুযায়ী, উভয় দেশের নাগরিকরা পরস্পরের দেশে ৩০ কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে বৈধভাবে কাজ করতে পারেন। তবে এই চুক্তির সুযোগ নিয়ে মূলত নেপালি শ্রমিকরাই চীনের তিব্বতে কাজ করতে যান, চীনা শ্রমিকদের নেপালে আসার ঘটনা খুব কমই ঘটে।

তিব্বত ও নেপালের মাঝে যেহেতু হিমালয়, তাই শীতের মাসগুলোতেও এই যাতায়াত কার্যত বন্ধ থাকে। তবে বছরের অন্য সময়, অন্তত ছয় মাস খোলা থাকে নেপালের হিলসা শহরের কাছে চীনা সীমান্ত। এই পথ দিয়ে তিব্বতে ঢুকে সেখানে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেন নেপালি শ্রমিকরা। তারা কয়েক মাসেই কয়েক লাখ নেপালি রুপির সমপরিমাণ অর্থ উপার্জন করে দেশে নিয়ে আসতে পারেন অনায়াসেই।

কিন্তু টাকলাকোটের একটি ঘটনা সেই ছবিটাকেই এবার আমূল বদলে দিয়েছে। বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে গত ১৮ জুন যেভাবে স্থানীয় শ্রমিকরা মিলে জাং ইয়াং নামে একজন চীনা শ্রমিকের ওপর হামলা চালান, অনেকটা সেভাবেই মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে তিব্বতে কর্মরত কয়েকজন নেপালি শ্রমিকের আক্রমণের শিকার হন একজন চীনা নাগরিক।

নেপালি নাগরিক তীর্থ খাদেড়া সেই খুনের ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। খুনের পর তিনি পালিয়ে নিজের দেশে ফিরেও যান, তবে চীনের পুলিশ তাকে নেপালের ভেতরে ঢুকে আটক করে নিয়ে গেছে বলে খবরে প্রকাশ। 

এঘটনার পর  চীন যাতে নেপাল থেকে শ্রমিকদের যাতায়াত বন্ধ না-করে দেয়, সেই অনুরোধ জানিয়ে নেপালের সরকার বেজিংয়ের কাছে একাধিকবার লিখিত অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু টাকলাকোট-সহ তিব্বতের একাধিক জায়গায় স্থানীয় জনরোষ এতটাই তীব্র আকার নিয়েছে যে, এখনও নেপালি শ্রমিকরা ফিরে গিয়ে সেখানে কাজ শুরু করতে পারেননি।

দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ইনস্টিটিউট অব চাইনিজ স্টাডিজের অধ্যাপক ও চীন-বিশেষজ্ঞ ড. অলকা আচারিয়া অবশ্য এধরনের ঘটনাগুলোতে মোটেই বিস্মিত নন।

ড. আচারিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীন ইদানীং তাদের বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুটো অঞ্চলের মধ্যে যে একটা বিরাট সাংস্কৃতিক ব্যবধান আছে, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।’

‘যেমন ধরুন, যখনই চীনের লোকজন একদল নেপালি, বাংলাদেশি বা শ্রীলঙ্কান শ্রমিকের সঙ্গে পাশাপাশি কাজ করছেন, তখন কিন্তু তাদের কর্মসংস্কৃতি বা ওয়ার্ক এথিকস, কাজের ধারাই শুধু আলাদা নয়– ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সবই পুরোপুরি আলাদা। ফলে একটা পর্যায়ে গিয়ে দুপক্ষের মধ্যে কনফ্লিক্ট বা সংঘাত বোধহয় অনিবার্য।’

বাংলাদেশের পায়রা বা তিব্বতের টাকলাকোটে চীনা নাগরিকদের হত্যায় এই সংঘাতেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে তার ধারণা।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশ পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও এই একই ধরনের সমস্যা হয়েছে। পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে চীন যে ইকোনমিক করিডর (সিপেক) বানাচ্ছে, সেখানেও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে চীনা শ্রমিকদের সংঘাত ঘটেছে অবিরত।

পায়রার ঘটনাতে বাংলাদেশ সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে ঢাকা ও বেজিংয়ের সম্পর্কে তেমন কোনও ‘ডিপ্লোমেটিক ড্যামেজ’ হয়নি। কিন্তু টাকলাকোটের ঘটনায় নেপাল তা পারেনি বলেই তাদের এখনও চড়া অর্থনৈতিক মূল্য দিতে হচ্ছে।