এ কেবলই কৃতজ্ঞতার সামান্যটুকু…

ঈদের দিন ( ১২ আগস্ট) বিকালে এক দল তরুণ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ঢোকেন। তাদের কারও হাতে ‘থ্যাংক ইউ’ লেখা কার্ড, কারো হাতে চকোলেট, কারও হাতে সাদা গোলাপ। তারা একে একে হাসপাতালের নতুন ও পুরনো ভবনের ওয়ার্ডে ঢোকেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, ওয়ার্ড-বয়, নিরাপত্তারক্ষীসহ সবার হাতে তুলে দেন এসব কার্ড, ফুল আর চকোলেট। কিন্তু তাদের সঙ্গে ছিল না কোনও ব্যানার, তারা যাননি কোনও সংগঠনের হয়ে। ডেঙ্গুর এ সময়টাতে যেভাবে হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্টাফরা মানুষকে সেবা দিয়েছেন, তারই কৃতজ্ঞতা জানাতে হাসপাতালে গিয়েছেন কয়েকজন বন্ধুর এই দলটি।

এই উদ্যোগের মূল কারিগর ফুয়াদ আহসান চৌধুরী। এই উদ্যোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঈদের কয়েকদিন আগে মনে হচ্ছিল ডেঙ্গু মোকাবিলায় যেই ইনহিউম্যান সার্ভিসটা ডাক্তার-নার্সসহ অন্যরা দিচ্ছেন, তাতে মনে হয় তারা আলাদা করেই একটা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত, সে ভাবনা থেকেই হাসপাতালে যাওয়া এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর এই কার্ড, ফুল চকোলেট কেবলই কৃতজ্ঞতা সামান্যটুকু। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার নির্দশনস্বরূপ এই কাজ।’

ফুয়াদ আরও বলেন, ‘এটুকু করা ছাড়াতো বেশি কিছু করার ক্ষমতাও আমার নাই। এটা একটা দায়বদ্ধতা,ডেঙ্গুসহ অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝাটে তারা নীরবেই আমাদের জন্য কাজ করে যান। বিনিময়ে পান গালমন্দ! এই আমরা যখন এক-দেড় সপ্তাহের ছুটি কাটাতে ব্যস্ত, তাদের অনেকেই তখনও দিয়ে যাচ্ছেন ননস্টপ সার্ভিস!

এই চিন্তা থেকেই ফুয়াদ ফেসবুকে একটা পোস্ট দেন। তাকে স্বাগত জানিয়ে বন্ধুরা তার সঙ্গে আছেন বলে জানান। তারপর  ঈদের দিন বিকাল পাঁচটার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে দায়িত্বরত সব চিকিৎসক-নার্স, ওয়ার্ডবয়-নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য,  ক্লিনিক্যাল প্যাথোলজিস্ট সবাইকে থ্যাংকস নোট, চকোলেট ফুল দেন তারা।

পুরো প্রক্রিয়ার ব্যাপারে তিনি জানান, আরেক বন্ধু ইশতিয়াক রেজা ফাহিদ প্রতিটি চকোলেটের পেছনে ‘থ্যাংক ইউ নোট’ লিখে এনেছিল। থ্যাংক ইউ লেখা কার্ডগুলো প্রথমে সাইজ করে কাটা, নোট লেখা আর ডেকোরেশনের পর আবার খামে ভরা, সেটা খুব কষ্টকর ছিল।

যাদেরকে এগুলো দেওয়া হলো, তাদের এক্সপ্রেসনের ব্যাপারে জানতে চাইলে ফুয়াদ বলেন, ‘জাস্ট অ্যামেজিং, ওখানে চিকিৎসকরা অনেক ব্যস্ত ছিলেন। তারপরও চিকিৎসক-নার্সসহ তাদের ফিজিক্যাল যে রিয়্যাকশন ছিল, সেটা যদি আপনি না দেখেন তাহলে বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। এতো সিম্পল একটা কার্ডে যে তারা কী পরিমাণ খুশি হয়েছেন…।’

নতুন ভবনের দুই তলা থেকে আট তলা পর্যন্ত প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়েছেন জানিয়ে ফুয়াদ বলেন, ‘কেবল অস্ত্রোপচার-কক্ষ ছাড়া, এমনকি অনুমতি নিয়ে আমরা ল্যাবরেটরিতেও গিয়েছি। প্রতিটি ওয়ার্ড ছাড়া শুধু পুরুষদের ঢোকা নিষেধ এমন ওয়ার্ড ছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়েছি। চিকিৎসকসহ সবার কাছে গিয়ে বলেছি, ঈদের দিন আপনারা আমাদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন, একইসঙ্গে ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেভাবে সামলিয়েছেন, সেজন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ। সবকিছু মিলিয়ে তারা একটু হকচকিয়ে গেছেন, এটা বুঝতে পেরেছি। কেবল তারাই নন, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আড়াই থেকে তিনশো’ বাচ্চা ছিল, তাদের সবাইকে চকোলেট দিয়েছি, তবে সেটা অবশ্যই চিকিৎসকের পরার্মশ নিয়ে।’

সবশেষে ফুয়াদ বলেন, ‘বন্ধুদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এটা সম্ভব হতো না।’

বন্ধুদের এই গ্রুপে থাকা আরেকজন হলেন বেসরকারি চাকরিজীবী সায়েম জাহান। কেন ঈদের দিনে ঢাকা মেডিক্যালে গেলেন জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘বন্ধুরা মিলে যাওয়া। চিকিৎসক, নার্সসহ যারা রয়েছেন, তারা এবার অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। তাই সবাই মিলে চিন্তা করলাম, তাদের একটু থ্যাংক্স দিয়ে আসি, এটাই আসলে কারণ আর কোনও কারণ নেই। ভেতরে থেকে ইচ্ছে করলো যেতে, তাই গেলাম।’

বন্ধুদের এই গ্রুপে আরও ছিলেন তরুণ উদ্যেক্তা এমডি দিদারুল ইসলাম সুজন। বাংলা ট্রিবিউনকে সুজন বলেন, ‘ঈদের দিন যখন আমরা বাসায় ছুটিতে আনন্দ করছি, পোলাও-মাংস-সেমাই খাচ্ছি, সেখানে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, টেকনিসিয়ানসহ সংশ্লিষ্টরা হয়তো এবার নামাজ পড়েই হাসপাতালে ছুটেছেন। তাদের একটা থ্যাংক্স নোট আমরা দিতে পারি, যদিও এটা কিছুই না, কিন্ত আমাদের মনে হয়েছে এটা করা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সাধারণ মানুষ হিসেবে সেখানে গিয়েছি। কোনও রাজনৈতিক পরিচয় না, কোনও ওষুধ কোম্পানির না। আমাদের এই যাওয়া নিয়ে ফেসবুকেও পোস্ট করার কথা ছিল না, তারপরও করা হয়েছে যদি আর কেউ উদ্বুদ্ধ হয় সেজন্য, তারপর যে সেটা নিয়ে সবাই এভাবে প্রশংসা করবেন সেটা ভাবিনি, চিকিৎসকরা এতো ইনবক্স করেছেন, আসলে আমরা এখন লজ্জায় পড়ে গেছি।’

তিনি আরও জানান, সবচেয়ে ভালো লেগেছে প্রথমে তারা অবাক হয়েছেন। তারপর তাদের প্রশ্ন ছিল- আপনারা কোন সংগঠন থেকে এসেছেন? কিন্তু যখন তারা শুনলেন, আমরা কেবলই বন্ধুরা এসেছি। তারা আসলে এক্সপেক্টই করেনি যে এরকম কেউ করতে পারে।