মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, টিন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে জিলপাড় বস্তির ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছিল। এসব ঘরের নিচ দিয়ে টানা হয়েছে গ্যাসের লাইন। প্লাস্টিকের পাইপ ব্যবহার করে জোড়াতালি দিয়ে অরক্ষিতভাবে টানা এসব গ্যাস সংযোগে জ্বলতো বস্তির বাসিন্দাদের রান্নার চুলা। ১৬ আগস্টের আগুনে পুড়ে যাওয়া বস্তির অংশের প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরে প্লাস্টিক পাইপের গ্যাস সংযোগ দেখা গেছে। আগুনের তাপে এসব পাইপ ফেটে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোতে গ্যাসের চুলার অস্তিত্ব না থাকলেও প্লাস্টিকের পাইপের উপস্থিতি ঠিকই পাওয়া গেছে।
বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ারা জানান, বস্তিতে সরকারি কোনও গ্যাস লাইন নেই। এখানে প্রতিটি বাড়িতে যে গ্যাসের সংযোগ ছিল সেগুলো সব অবৈধ। বস্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন দুলাল হোসেন ও রহিম। ক্ষমতাসীন দলের লোক পরিচয় দিয়ে ও জনপ্রতিনিধিদের হাত করে দীর্ঘদিন ধরে তারা এই ব্যবসা করে আসছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বস্তির এক বাড়িওয়ালা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বস্তিতে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিতেন দুলাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি। সে বিভিন্ন অফিস ও স্থানীয় নেতাদের টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখতো। সে এভাবে অনেক টাকার সম্পত্তি গড়েছে।’
মিরপুর ৬ নম্বর ঝিলপাড় বস্তিতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন মকবুল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানায়। অভাবের কারণে গ্রামের ভিটা বিক্রি করে ৪২ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। বস্তিতে তার দুটি ঘরের একটি বাড়ি ছিল, যা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘যারা আগে এই বস্তিতে থাকতো, তারা ঘর তুইলা, রুম ভাড়া খাইয়া এখন বড় বড় দালান করছে। কয়েকটা বাড়ির মালিক হইছে। তারা এই বস্তির মানুষগো দিয়া চাষ-বাস কইরা কোটিপতি হইছে। আজকে আমরার এই দুর্দিনে তাগো দেহা যায় না। যা ক্ষতি হবার বস্তির মানুষেরই হইছে।’
বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ারা জানান, দুলাল হোসেন পুরো বস্তিতে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাস সাপ্লাই দিতো। প্রতিমাসে বস্তির বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে গ্যাস বিল বাবদ ৫৫ লাখ টাকা তুলে নিতো। এক চুলা পাঁচশ’ আর দুই চুলার জন্য এক হাজার টাকা ছিল তার রেট। অপরদিকে, প্রতিঘরে এক বাতির জন্য একশ’ টাকা। বাতি ও ফ্যান থাকলে তিনশ’ টাকা, টিভি থাকলে দিতে হতো পাঁচশ’ টাকা। আর ঘরে কারও ফ্রিজ থাকলে এক হাজার টাকা করে মাসিক বিল দিতে হতো।
বস্তির বাসিন্দারা জানান, গ্যাস বিল তোলার কাজটি করতো জিতু, মোনতাজ। তারা দুলালের সহযোগী। দুলাল মিয়া ও রহিম দুই জনই বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাসের সাপ্লাই দিতেন। দুলাল ও রহিম মিরপুর রূপনগরের ক্ষমতাশীন দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
তবে বস্তিতে অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবসার সঙ্গে নিজের কোনও সম্পৃক্তা নেই বলে দাবি করেন মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার হাজী রজ্জব হোসেন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বস্তিতে গ্যাসের অনেক অবৈধ সংযোগ আছে। তবে প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে গ্যাসের লাইন টানার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যারা অবৈধ গ্যাসের ব্যবসা করছে তারা কেউই আমার লোক নয়। আবার অনেকেই আমাদের নামে কথা বলছে। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’
বস্তির বাসিন্দা রহিমা বেগম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে ১৫ থেকে ২০ হাজার ঘর রয়েছে। প্রতি চুলা ছাড়াও আবার ঘর প্রতিও ৫০০ করে টাকা নেওয়া হতো। সব টাকা দুলাল লিখে লিখে নিতো। তার কাছে সব হিসাব আছে।’
ঝিলপাড় বস্তির বাড়িওয়ালা সাদেক মিয়ার বাড়িতে এক রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন মো. মোহসিন। তিনি ভ্যানগাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির বিলসহ এক রুমের ভাড়া দেই দুই হাজার ৭০০ টাকা। আগুনে তো সব জ্বইলা গেছে। এখন কিছু সাহায্য-সহযোগিতা পাইলে ভালো হইতো। কমিশনারের অফিস থেকে কয়েকজন আসছিল। আমার নাম আর বাড়ির মালিকের নাম লিখে নিয়ে গেছে। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ পরিচয় নেয় নাই। সরকার যদি কোনও অনুদান দেয় আর তখন যদি আমার নাম কইরা অন্যজন নিয়া ফালায়, তবে আমি তো কিছুই পাবো না। এই কারণে তালিকায় নাম লেখাইয়াও ভরসা পাইতাছি না।’
তিনি বলেন, ‘ঝিলপাড় বস্তিতে অবৈধ গ্যাস লাইন ব্যবহারের বিষয়ে তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এতে যদি তিতাসের কেউ জড়িত থাকে তাদের বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহণ করা হবে।’
ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শাহিদ সারওয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বস্তি এলাকায় ডেসকোর পক্ষ থেকে পোল মিটার বসানো রয়েছে। সেই মিটার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে তারা ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়াও অনেকে অবৈধভাবে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়ে থাকে। তবে আমরা আমাদের রুটিং ওয়ার্ক অনুযায়ী সেসব অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ কেটে দিয়ে আসি। বিভিন্ন সময় ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে অভিযানও পরিচালনা করা হয়।