‘বিদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা নির্ভরতা কমছে, বাংলাদেশে বাড়ছে’

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘কয়লায় শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন

বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৩ গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনায় বড় প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে চীন, ভারতসহ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। সরকারের বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী বিদেশি অর্থায়নে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা আরও ২৯টি বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশই পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে এসে নবায়ন যোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। আর বাংলাদেশে কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পরিবেশবাদীদের সংগঠনগুলো।

বুধবার (৬ নভেম্বর) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর রুনি মিলনায়তনে ‘কয়লায় শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে মার্কেট ফোর্সেস এবং থ্রি ফিফটি নামক দুটি প্রতিষ্ঠান। আর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৩ গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনায় বড় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করছে চীন, যুক্তরাজ্য, জাপান ও ভারতের মতো বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, ক্রমবর্ধমান বিদেশি অর্থায়নে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১টি থেকে বাড়িয়ে ৩০টিতে উন্নীত করা হবে। বিদ্যমান ৫২৫ মেগাওয়াটের বিপরীতে কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ৩৩ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে-যা বায়ুমণ্ডলে বার্ষিক ১১ কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করবে। আর এটি সত্যিকারভাবে একটি কার্বন বিস্ফোরণের ঘটনা, যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে চরম হুমকির মুখে ফেলবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত বিশ্লেষণ বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই বাংলাদেশ তার স্থলভাগের ১১ শতাংশ হারাবে এবং চার ও পাঁচ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার ঝুঁকি ১৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেবে, যা উপকূলে বসবাসরত ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকা হুমকির মধ্যে ফেলবে। তারপরও পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯টি কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র জনজীবনের বিপর্যয়কে বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।

এসময় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা তুলে ধরে বলা হয়, বড় আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা মূলত বৈদেশিক ঋণ সহায়তা নির্ভর, যেটি সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ভার বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। এতে বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য আরও প্রকট করে তুলবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশকে বার্ষিক দুইশ’ কোটি ডলার মূল্যের ৬ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করতে হবে-যা বাংলাদেশকে কয়েক দশকের জন্য উচ্চমূল্যের কয়লা আমদানির ফাঁদে ফেলে দেবে। এতে নতুন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কাও তৈরি হতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে বাপা’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, সরকারি তথ্য দিয়েই তৈরি এই গবেষণাপত্র। এখানে আমাদের নিজস্ব কোনও তত্ত্ব নেই। সারাবিশ্ব কয়লা ত্যাগ করছে, বাংলাদেশ কয়লাকে গ্রহণ করছে। আমরা সুন্দরবন রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে সরকারকে ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ডক্যুমেন্ট জমা দিয়েছি। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের করা থিওরি সেগুলো, তারা গবেষণা করে দেখিয়েছেন রামপাল যদি চালু হয় আমাদের সুন্দরবনের ক্ষতি হবে। একজন সায়েন্টিস্ট স্টাডি করে রিপোর্টে লিখেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের যে ছাই তৈরি হবে-সরকার যতই বলুক কিছু হবে না- বাস্তবে সেই ছাই ধীরে ধীরে দেশব্যাপী ছড়াবে। এটা ঢাকা, নরসিংদী হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে। সরকার এই ছাই নিয়ে যা বলছে সেটা সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। আমাদের গবেষণায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে, কিভাবে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর এখন আরও ২৯টি এরকম বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পরিকল্পনা হচ্ছে। কাজেই আমরা বিধ্বস্ত হয়ে যাবো এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে, তাই উৎপাদন করতে হবে। সরকারের অঙ্গীকারের জায়গাগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রাধান্য পেয়েছে। এই সরকার তাদের তৃতীয় মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে অগ্রগতি দেখিয়েছে তা অভূতপূর্ব এবং আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি অনেকখানি কমিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আত্মঘাতী কোনও প্রক্রিয়ায় করা যাবে না। আমাদের জীবন, প্রকৃতি, পরিবেশ এবং দেশকে ধ্বংস করে করা উচিত হবে না। বাংলাদেশ একটাই, কক্সবাজার আর সুন্দরবনও একটাই। এগুলোকে বিপন্ন করে বিদ্যুৎ প্রকল্প আমরা দেখতে চাই না। কাজেই এখানে একাধিকবার বলা হয়েছে যে আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর লাগামহীন নির্ভরতাকে আবারও বিবেচনা করতে হবে। এটা এক ধরনের মাদকীয় নির্ভরতা।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘কয়লায় শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন

তিনি আরও বলেন, আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে মানা করছি না। কিন্তু যেখানে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব, সেখানে কয়লার ওপরে মাদকীয় নির্ভরতা কিভাবে থাকে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার আছে, যার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তগুলো আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জাইকা, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর চাপের মুখে নতি স্বীকার করে আমরা এভাবেই বিনিয়োগে যাচ্ছি। যে কয়টি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে এগুলোর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, পরিবেশগত মূল্যায়ন কোনটারই আমাদের জানামতে তথ্য নেই। এই ধরনের প্রকল্প কোনও অবস্থায় আমাদের আইনগতভাবে পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়া গ্রহণ করা অসম্ভব। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে চলমান প্রকল্পগুলো স্থগিত রেখে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য পরিবেশগত মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের কারণেই বাংলাদেশ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবে এমন মন্তব্যও করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল। এতে আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সদস্য শারমিন মুর্শিদ।