মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের কেনাকাটায় ২৭৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ

মীর মোশারফ হোসেন ও কৃষ্ণ কুমার পালসিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য নিম্নমানের ব্যবহার অনুপযোগী যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনাকাটায় ২৭৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। আর এই টাকা আত্মসাতে মূল ভূমিকা রাখেন প্রকল্প পরিচালক কৃষ্ণ কুমার পাল, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের একান্ত সচিব (এপিএস) মীর মোশারফ হোসেন এবং তাদের সহযোগিতা পাওয়া আটটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস মোশারফ হোসেন একইসঙ্গে রাজধানীর বনানী থানা আওয়ামী লীগের নেতা। দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক এরইমধ্যে প্রকল্প পরিচালক কৃষ্ণ কুমার পালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। গত ১ ডিসেম্বর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংস্থার উপ-সহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ প্রকল্প পরিচালক কৃষ্ণ কুমার পালকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর আগে ২৬ নভেম্বর কৃষ্ণ কুমারকে তলব করে দুদক। স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি অনুসন্ধানে গঠিত দুদকের স্পেশাল টিমের দলনেতা ও সংস্থার উপ-পরিচালক সামছুল আলম তাকে তলব করে চিঠি পাঠান।

এছাড়া, অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মীর মোশারফ হোসেনকে তলবি নোটিশ পাঠানো হয়েছে গত ২২ জানুয়ারি। দুদকের জনসংযোগ শাখা জানায়, মোশারফ হোসেনকে নোটিশ পাঠান সংস্থার উপ-পরিচালক মো. সামছুল আলম। ওই নোটিশে তাকে আগামী ২৭ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক কৃষ্ণ কুমার পাল নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কোনও দুর্নীতি হয়নি। সব কাজ সুষ্ঠু আর নিয়মতান্ত্রিকভাবেই হয়েছে।’ এ বিষয়ে দুদককে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

তবে মীর মোশারফ হোসেনের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি অনুসন্ধানে গঠিত দুদকের বিশেষ দলের দলনেতা হলেন সংস্থার উপ-পরিচালক সামছুল আলম। তিন সদস্যের অনুসন্ধান দলের অন্য দুই সদস্য হলেন উপ-সহকারী পরিচালক সহিদুর রহমান ও ফেরদৌস রহমান। মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়টিও তারাই অনুসন্ধান করছেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান দলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের কাছ থেকেও কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দুদক সূত্র জানায়, প্রকল্পের দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমে ২৩ ধরনের নথি পর্যালোচনা করেছে দুদক। নথিগুলোর মধ্যে আছে— ১. মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বিভাগীয় প্রধানের চাহিদাপত্র। ২. পরিচালক ও অধ্যক্ষের চাহিদাপত্র। ৩. অনুমোদিত বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা। ৪. বরাদ্দপত্র।

৫. প্রশাসনিক অনুমোদন। ৬. দরপত্র সংক্রান্ত কমিটি গঠনের নথিপত্র। ৭. অনুমোদিত স্পেসিফিকেশন। ৮. বাজার দর কমিটির প্রতিবেদন। ৯. দরপত্র বিজ্ঞপ্তি ও ওয়েবসাইটের কপি। ১০. দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির প্রতিবেদন। ১১. কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন। ১২. দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন। ১৩. তুলনামূলক বিবরণী। ১৪. নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড। ১৫. চুক্তিপত্র। ১৬. কাজের জামানত ১৭. ব্যাংক গ্যারান্টি। ১৮. কার্যাদেশ। ১৯. ব্যয় মঞ্জুরি। ২০. সার্ভে কমিটির নথিপত্র। ২১. ইনস্টলেশন রিপোর্ট। ২২. পরিশোধিত বিলের কপি। ২৩. পরিশোধিত চেকের কপি।

এসব নথি পর্যালোচনায় দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, দুর্নীতির কারণে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রকল্পের চারটি উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। উদ্দেশ্যগুলো হলো—

১. চিকিৎসা শিক্ষার জন্য মেডিক্যাল কলেজ ভবন নির্মাণ।

২. জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে চিকিৎসক তৈরি।

৩. চিকিৎসা শিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ।

৪. চিকিৎসক-পেশাজীবীদের কর্মসংস্থান তৈরি।

২০১৪ সালের মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিরাজগঞ্জসহ সারাদেশে একযোগে পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। ওই বছরই সিরাজগঞ্জে শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়।

দুদক সূত্র জানায়, ‘শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প’ নামে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এবং গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে ৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সিরাজগঞ্জ সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে শিয়ালকোল ইউনিয়নে ৩০ একর জমির ওপর মেডিক্যাল কলেজ ও ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের প্রথম ধাপে প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল ৬৩৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। গত বছরের অক্টোবরে প্রকল্পের খরচ ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয়। এতে মোট খরচ দাঁড়ায় ৮৮৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা। টাকার অংকে খরচ বেড়েছে ২৪৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে।

প্রকল্প ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রের বাজার দর বেড়ে যাওয়া, নতুন যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব সংযোজন, মাটি ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে খরচ বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, এসপিওয়াই ইন্ট্রাঅপারেটিভ ইমেজিং সিস্টেম, কিডনি ডায়ালাইসিস মেশিন, হার্টের রোগীদের জন্য সিসিইউ এবং আইসিইউ ইউনিটসহ ৬০টি মেশিন কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে। এই কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা। আর আসবাবপত্র কেনাকাটার নামে লুটপাট হয়েছে ২০ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি এ বিষয়ে অভিযোগ পাওয়া পর যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।