এলইডি বাতির আলোয় ঝলমলে দক্ষিণ ঢাকা (ভিডিও)

এলইডি বাতির সুবিধা

বদলে গেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সড়ক বাতি। পুরনো সোডিয়াম বাতির বদলে এখন অত্যাধুনিক বিদেশি এলইডি বাতির আলোয় সন্ধ্যা হলেই ঝলমল হয়ে ওঠে দক্ষিণ ঢাকা। এই আলোর প্রভাবে কমেছে ছিনতাই,চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডও—এ দাবি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা বলছে, সড়কে সুন্দর আলো থাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ড অনেক কমেছে। আর সিটি করপোরেশন বলছে, অত্যাধুনিক বাতি দেওয়ায় দৃষ্টিসীমার সবকিছু দেখা যাচ্ছে। ফলে  রাতের ফাঁকা সড়কে অনেকেই এখন ঘুরতে বের হচ্ছেন। কেবল তা-ই নয়, পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এখন দক্ষিণ ঢাকাকে নিরাপদ মনে করছেন।

এলইডি বাতি প্রকল্পের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘এই বাতির কারণে গভীর রাতেও নারী-পুরুষ স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারছেন। নাগরিকদের নিরাপত্তা বেড়েছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘নগরী যত আলোকিত হবে ততই অপরাধ কমবে। দক্ষিণ সিটির মতো উত্তর সিটিতেও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এলইডি বাতির মতো সিসি ক্যামেরা লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’ আর নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বার হোসেন বলেন, ‘একসময় রাতে বের হতে মানুষ ভয় পেতো। এখন ঢাকাকে বিদেশের মতো লাগছে।’

6

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি নির্বাচনে ঢাকা শহরকে আধুনিক ও ঝকঝকে বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি ছিল মেয়র সাঈদ খোকনের। সবুজ ও আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি নগরবাসীর মনোযোগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নির্বাচিত হওয়ার পর সাঈদ খোকন বিষয়টি সরকারের কাছে উপস্থাপনে সক্ষম হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এর গুরুত্ব অনুধাবন করেন। এরপর উন্নত বিশ্বের আদলে গ্রহণ করা হয় এলইডি বাতি প্রকল্প। প্রায় ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে দক্ষিণ ঢাকার সড়কে ৪১ হাজার ১৩৩টি এলইডি সড়ক বাতি লাগানো হয়েছে। এছাড়া নবগঠিত ১৮টি ওয়ার্ডেও ১৫ হাজার এলইডি বাতি স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এখানকার পুরনো ৫টি অঞ্চলের জন্য মোট ১০টি প্যাকেজের মাধ্যমে ৪০ ওয়াটের ২৭ হাজার ৫১টি, ৮০ ওয়াটের চার হাজার ৪৩টি, ১২০ ওয়াটের তিন হাজার ২০২টি, ১৫০ ওয়াটের তিন হাজার ৮১১টিসহ মোট ৩৮ হাজার ৯৮টি বাতি স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত প্রকল্পে নতুন করে আরও তিন হাজার ৩৫টি বাতি লাগানো হয়।

5সূত্র জানায়, এসব বাতির মধ্যে ১৫০ ওয়াটের বাতি প্রতিসেট কেনা হয়েছে ৫৬ হাজার ৮৯৪ টাকা করে। ১২০ ওয়াটের বাতি প্রতিসেটের দাম ৪৮ হাজার ৩৯০ টাকা। এছাড়া ৮০ ওয়াটের এলইডি বাতির প্রতিসেটের  দাম ৪৩ হাজার ৪৯০ টাকা। প্রতিটি বাতির গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার ঘণ্টা। এই হিসেবে দিনের ১২ ঘণ্টা বাদ দিলে এই বাতির গ্যারান্টি দাঁড়ায় প্রায় ১১ বছরের বেশি।

বাতিগুলো এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত যে, দিনের আলো শেষে রাতের অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠবে। এক্ষেত্রে কখনও যদি দিনে ঘোর মেঘের কারণে অন্ধকার নেমে আসে, তখনও এসব বাতি জ্বলে উঠবে। তবে কেন্দ্রীয় ‍নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বাতিগুলো চাইলেই বন্ধ করা যাবে। আবার কোনও এলাকার বাতি যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বার্তা নিয়ন্ত্রণকক্ষে চলে যাবে।

4জানা যায়, ডিএসসিসির এই সড়ক বাতিগুলোর সেট মেলাতে আনুষঙ্গিক আরও ৩০টি আইটেম কিনতে হয়েছে। এরমধ্যে পোল, ব্রাকেট, বিভিন্ন ধরনের ক্যাবল, রিমোট টার্মিনাল ইউনিট (আরটিইউ), ডাটা কনসেনট্রেটর ইউনিট (ডিসিইউ), স্মার্ট অ্যানার্জি ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার, সার্কিট ব্রেকার, ম্যাগনেটিক কন্ট্রাক্টর,ভোল্টেজ স্ট্যাবিলাইজার রয়েছে।

এলইডি লাইটের আলোতে রাতের ফাঁকা সড়কে বিভিন্ন এলাকায় যুবকদের ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধুলাও করতে দেখা গেছে। বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ১২টায় সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয় সংলগ্ন সড়কে একদল যুবককে ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়। জানতে চাইলে খুদে ক্রিকেটার আরিফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, দিনে কোথাও খেলতে পারি না। ফাঁকা রাস্তা পাই না। রাতে সড়কটি ফাঁকা থাকে। তখন এলইডি বাতিতে পুরো রাস্তা আলোকিত থাকে। তাই বন্ধুরা সবাই মিলে ১১টার পর রাস্তায় এক ঘণ্টা খেলতে বের হই। আমরা প্রতিদিনই রাতে এখানে খেলি।’

3এদিকে দক্ষিণ সিটি এলাকার বেশ কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,উত্তরের তুলনায় দক্ষিণ সিটিতে রাতে  বেশি রিকশা চলাচল করে। তারা জানিয়েছেন, রিকশাচালক অনেকে রাতে গ্যারেজে থাকেন। এজন্য গ্যারেজ মালিককে নির্দিষ্ট হারে ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু দক্ষিণ সিটিতে রাস্তাগুলো আলোকিত থাকায় তারা রাতের ফাঁকা সড়ক কিংবা ফ্লাইওভারের নিচে রিকশা রেখে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন।

বাতির আলোতে সড়ক নিরাপদ মনে করায় ডিএসসিসি এলাকায় ভাসমান মানুষের সংখ্যাও তুলনামূলক বেড়েছে বলে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে এই প্রথম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়েছে।  এই বাতির অনেক সুফল রয়েছে। সড়কে এখন ছিনতাই কম হচ্ছে। মানুষ রাতে অনায়াসে হাঁটতে পারেন। নারীরাও নির্ভয়ে চলতে-ফিরতে পারছেন। এই প্রকল্পটিতে মেয়র সাঈদ খোকনের অগ্রাধিকার ছিল। তার ইচ্ছায় আমরা দক্ষিণের পুরো শহরকে আলোকিত করার চেষ্টা করেছি।’

2তিনি আরও বলেন,‘বাতিগুলো যেকোনও স্থান থেকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাতি নিয়ন্ত্রণে অত্যাধুনিক পাওয়ার লাইট কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। রাতে প্রয়োজন অনুপাতে আলো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে। কোনও বাতি নষ্ট হলে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। প্রতিদিন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়  স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিগুলো জ্বলে ও নেভে। প্রতিটি বাতি দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ডিজাইন করা হয়েছে। বাতির আলো চোখের জন্যও কোনও ক্ষতিকর নয়।’

পুরনো ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসিন্দা সুমাইয়া আক্তার কাজ করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। রাতেও তাকে ডিউটি করতে হয়। সেজন্য রিকশা বা সিএনজিতে যাতায়াত করতে হতো। কিন্তু এখন তিনি হেঁটেই অফিস থেকে বাসায় ফেরেন।

সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘দিনের চেয়ে রাতের ঢাকাকে এখন অনেক নিরাপদ মনে হয়। রাতে যানজট কম থাকে। আর সড়কে যে আলো থাকে তাতে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। তাই রাতে বাসায় হেঁটে আসি। শরীরেরও উপকার হয়।’

1জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আসলে মেয়র খোকন সড়কের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। একসময় রাতে বের হতে মানুষ ভয় পেতো। ছিনতাই, চাঁদাবাজি অহরহ ছিল। এখন অনেক কমেছে। রাতের ঢাকায় সুন্দরভাবে হাঁটা যায়। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। দক্ষিণ ঢাকার সড়কগুলো এখন বিদেশের মতো লাগছে। দুই সিটিতে যদি এই প্রকল্প সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে অনেক ভালো হবে।’

ডিএসসিসি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন এই ঢাকাকে বদলে দেওয়ার। সে অনুযায়ী কাজ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অর্থ চেয়েছি। তিনি সহযোগিতা করেছেন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পুরনো এলাকায় এখন ৪০ হাজারের বেশি আধুনিক এলইডি বাতি জ্বলে। অন্যান্য শহর,সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় যদি এমন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে রাতের শহর অনেক নিরাপদ থাকবে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটা সত্য যে নগরী যত আলোকিত হবে, ততই আপরাধ কমবে। আপনারা তো দেখতে পাচ্ছেন এখন চাঁদাবাজি ও ছিনতাই কমেছে। আলোকিত ঢাকায় মানুষ নিরাপদে চলাফেরা করতে পারছেন। দক্ষিণ ঢাকায় এলইডি বাতি বসেছে। উত্তর ঢাকায়ও কাজ চলছে। অনেক জায়গায় ক্যামেরা বসেছে। পুলিশের পক্ষ থেকেও সিসি ক্যামেরা বসানোর একটা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।’