আল মারকাজুল ইসলামীর কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্থাটি সরকারের সহযোগিতার মধ্য দিয়েই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও সন্দেহভাজনদের সৎকার কাজে যুক্ত হয়েছে। তাদের লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ কাজে অনুমোদন দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানও আল মারকাজুল ইসলামীর কাজে যুক্ত হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিশেষ এই পরিস্থিতিতে নজরদারির অভাবে উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর অনুসারীরা সামাজিক-সহযোগিতা নিয়ে সক্রিয় হয়েছে। মুফতি শহিদুল ইসলামের মারকাজুল ইসলামীর মতো আরও অনেক সংগঠনই বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে সক্রিয় হয়েছে, এমন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কোনও কোনও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
মারকাজুল ইসলামী হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানা গেছে, দুবাইতে বসে মারকাজের পুরো কার্যক্রম দেখভাল করেন মুফতি শহিদুল ইসলাম। হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ও নতুনভাবে এ সংগঠনকে সংগঠিত করার নেপথ্যে থাকার অভিযোগে দেশেও ফিরতে পারছেন না তিনি। তবে, দুবাই থেকেই মারকাজের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বর্তমানে তার ছোট ছেলে মোহাম্মদ হামযা প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলা ট্রিবিউনকে মোহাম্মদ হামযা বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, সরকার অনেক সহযোগিতা করছে। আমাদের পিপিই দরকার, সেটা সরকার দিয়েছে। আরও কিছু সংগঠন আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা রেডক্রস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি যুক্ত হয়েছে।’ এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি কাফন, দাফনের কাজে আর্থিক সহযোগিতা করছেন বলে জানান মোহাম্মদ হামযা।
সংগঠনটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ‘সরকারের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি তাদের মারকাজের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছেন। এই ব্যক্তি মারকাজের স্বেচ্ছাসেবায় গাড়ি, জ্বালানি সুবিধা দিয়েছেন।’
গত বছরের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা তাদের ওপর নির্যাতনের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া মাঠে মহাসমাবেশ করে। অভিযোগ রয়েছে, ওই সমাবেশে রোহিঙ্গাদের সাদা টি-শার্ট ও গেঞ্জি সরবরাহ করেছিল আল-মারকাজুল ইসলামী। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুটি এনজিও’র কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। দুটি সংস্থা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক এনজিও ‘আদ্রা’ ও মুফতি শহিদুলের ‘আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ’। ওই সময় সংস্থা দুটোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও ক্যাম্প এলাকায় নিষিদ্ধই আছে এনজিও দুটি। এর বাইরে তো আমাদের দেখার বিষয় না।’
সিটিটিসির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, গত বছর হরকাতুল জিহাদের নেতা আতিকুল্লাহ ওরফে জুলফিকারকে গ্রেফতারের পর বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এরমধ্যে, কয়েকটি তথ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিবেচনা করে প্রক্রিয়াটিকে ভিন্নভাবে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
তবে, সেই মারকাজুল ইসলামীই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও সন্দেহভাজন মরদেহের সৎকার কাজে যুক্ত হয়েছে, তা অজানা ছিল বলে জানায় রাষ্ট্রীয় একাধিক গোয়েন্দা সূত্র। একাধিক প্রভাবশালী সংস্থার সূত্র জানায়, বিষয়টিকে তারা নতুন করে পর্যালোচনাপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে।
অবশ্য, এ বিষয়ে সিটিটিসির উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মারকাজুল ইসলামীর মরদেহ সৎকারের বিষয়টি তাদের পর্যবেক্ষণে নেই। তার ভাষ্য, এটার সঙ্গে সিটিটিসি’র কোনও সম্পর্ক নেই।
মারকাজের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হামযা জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজমের মাধ্যমেই সরকারি দিকনির্দেশনা পায় মারকাজুল ইসলামী।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিষিদ্ধ সংস্থাটি সরকারের অনুমোদন নিয়ে মরদেহ সৎকার কাজে যুক্ত হলো কীভাবে এমন প্রশ্ন ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজমের কাছে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘তারা মূলত ভলেন্টিয়ারি অর্গানাইজেশন। ওরা অনুমতি চেয়েছিল।’
এনজিওটি কারা পরিচালনা করছে তা অনুসন্ধানের সুযোগ ছিল কিনা– এমন প্রশ্নের উত্তরে সাইফুল্লাহিল আজম বলেন, ‘না, সুযোগ ছিল না। ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই আমাদের কাজ শুরু হয়েছে। আর আমার অ্যাপয়েনমেন্ট সংস্থাটি অনুমতি পাওয়ার পর হয়েছে।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মারকাজুল ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছে- এই তথ্যটিও তারা অজানা ছিল বলে জানান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই যুগ্ম সচিব।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (নিবন্ধন ও নিরীক্ষা) মো. শাহাদাৎ হোসাইন (অতিরিক্ত সচিব) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের কার্যক্রম বন্ধ। তাদের অন্যান্য কার্যক্রম চলছে।’
তবে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সুপারিশ অনুযায়ী আল মারকাজুল ইসলামীর বিষয়টি নিয়ে কোনও ফলোআপ করা হয়েছে কিনা, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ রয়েছে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মুফতি শহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে... এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব মো. শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, ‘না, চেয়ারম্যান তো আসে নাই। তিনি তো বিদেশে। তাকে আর দেওয়া হবে না।’
তবে, এনজিও ব্যুরোর একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘যেসব সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, সেসব অভিযোগের পক্ষে খুব একটা তথ্য-প্রমাণ আমরা হাতে পাইনি। ওই অভিযোগগুলোর বিস্তারিত বিবরণ থাকে না। এনজিও বিষয়ক যে আইন রয়েছে, সে আইন অনুযায়ী এসব সংস্থাকে শোকজ করতে হয়। কিন্তু, এ ধরনের অভিযোগে শোকজ করার সুযোগ থাকে না। বিশেষ করে এক শব্দে কোনও অভিযোগ দেওয়া হলে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ কম থাকে।’
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিতে মারকাজুল ইসলামীর মতো বিতর্কিত সংস্থা কেন মরদেহ সৎকারে নেমেছে, এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক সেনা কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে দেশে বিশেষ সমস্যাপ্রবণ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাসে যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের পাশে আত্মীয়স্বজনও থাকছেন না। মরদেহ ফেলে যাচ্ছেন। আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ছিন্নভিন্ন অবস্থায় আছে। তারা ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না। জনপ্রতিনিধিরা মানুষের পাশে নেই। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখন সিনিয়র সচিবদের দিয়ে কো-অর্ডিনেশন করাতে হচ্ছে। সামনের দিনে আরও খারাপ পরিস্থিতি আসবে বলে আশঙ্কা করছি। সেই পরিস্থিতিতে এ ধরনের অর্গানাইজেশন আসবে, এটা স্বাভাবিক।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এ ধরনের আরও সংগঠনকে দেখতে পাবেন। কারণ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কী করণীয় আছে? তাদের তো কোনও সংস্থা নেই, যারা এগুলো হ্যান্ডেল করবে। একজন মানুষ যখন খারাপ অবস্থায় থাকে, তখন খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকতে চায়। আমি তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেই দশা দেখছি। চিকিৎসক এবং নার্স মিলিয়ে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী খেয়াল করেছে আমাদের কতজন চিকিৎসক প্রয়োজন হবে?
তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়াতে আমাদের দেশেই ম্যানেজমেন্ট খুব খারাপ। এই অবস্থা কালকে শেষ হয়ে যাবে, তা নয়। এটা আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে আমি অবাক হবো না, যদি এ ধরনের অর্গানাইজেশন কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিভিন্ন জায়গায় হয়তো ইতোমধ্যে ভলান্টিয়ারি (স্বেচ্ছাসেবী) কার্যক্রম করছে। আমরা হয়তো জানি না, হয়তো মানুষের সিমপ্যাথি নিচ্ছে। এ ধরনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মরদেহ-সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোতেও তাদের প্রতি দুর্বলতা তৈরি হতে পারে।’
উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে প্রথম আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন মুফতি শহিদুল ইসলাম। এই সংস্থাটি প্রথমে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এনজিও কার্যক্রমের আড়ালে তিনি হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতেন বলে অভিযোগ আছে। নব্বই দশকের শুরুতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মারকাজের কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে বাবর রোড ও শ্যামলীতে সংস্থাটির নিজস্ব সম্পত্তি রয়েছে। ওই সময়ে দেশের বিভিন্ন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির অর্থ-সহযোগিতায় দিনে-দিনে পরিসর বাড়ে সংস্থাটির। এই অর্থায়নে সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ছিল।