‘ঘরবন্দি’ কথাতেই আপত্তি মানসিক চিকিৎসকদের

শিশু (1)

করোনা পরিস্থিতিতে প্রায় সাড়ে তিন মাস ঘরের ভেতরে শিশু-কিশোররা। এ পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়ার জন্য অস্থিরতা যেমন বাড়ছে, তেমনই দীর্ঘসময় পরে বাইরে গিয়ে খাপ খাইয়ে নিতেও তাদের সমস্যা হচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, খেলতে যেতে না পারা, সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মাঝে মাঝেই অস্থিরতা দেখায় শিশুরা। দিনের রুটিন বদলে যাওয়ায় রাতে ঘুমও হয় না অনেক সময়। মানসিক চিকিৎসকরা বলছেন, মাইন্ড-সেট বদলাতে হবে। ঘরবন্দি নয় বরং বাইরের পৃথিবীটাকেই বন্দি হিসেবে শিশুর সামনে হাজির করতে হবে। তাদের মতে, শিশুদের দিন-রাতের রুটিনে পরিবর্তন এলে সেটি বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবে না। শরীরের ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’ এলোমেলো হয়ে গেলে চিন্তা ও আচরণ দুটোই পরিবর্তন হয়ে যায়।
এইচএসসি পরীক্ষার্থী লগ্ন তানভীর গত চার মাস ঘরে বসে আছেন। জরুরি প্রয়োজনে যে এক-দুইবার বের হয়েছেন সেই অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ঘরে থেকে এমন একটা নিরাপত্তার বলয় তৈরি হয়েছে যে বাইরে গিয়ে খুব অদ্ভুত অনুভূতি হয়। অল্প কিছুতেই ভয় লাগছে, বিরক্তও লাগছে। অথচ এসবের মধ্যেই আগে যাতায়াত করতাম। তিনি মনে করেন, এই মহামারি শেষ হলে যে শিশু-কিশোররা বের হবে তাদের জন্য যথাযথ নির্দেশনা দরকার হবে।

দীর্ঘদিন পর নিজের দুই শিশুকে বাসার পাশেই বের করেছিলেন সাংবাদিক নাজনীন আখতার তন্বী। অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ৪ মাস পরে যখন মেয়েদের বাইরে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম, ছোটটা প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। অনেক অপেক্ষার পর বাইরে যাওয়ার অনুভূতি তাদের সুখকর হয়নি। রাস্তায় গাড়ি দেখে ভয় পাচ্ছিল, গাড়ির হর্ন শুনলে চমকে উঠছিল, চিৎকার করছিল। এর আগে এসবেই অভ্যস্ত ছিল ওরা। চার মাসের অনভ্যস্ততায় এমন হয়েছে। খোলা জায়গা না পেয়ে একটা গলিতে ওদের ছেড়ে দিলাম দৌড়ানোর জন্য, কিন্তু তাদের ভয় আর কাটে না।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৬২ হাজার ৪১৭ জন।  মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৫২ জন। মৃত্যুহার বাড়ার এই সময়টাতে শিশুদেরকে আরও সতর্কতার সঙ্গে রাখা ও প্রাথমিক কিছু বিষয়ে অভ্যস্ত করে তোলা জরুরি বলে মনে করছেন মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসকরা।

শিশু (3)

৭ বছরের নেহাল ও ১৩ বছরের রওনকের মা নাসিমা মনে করেন শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ জন্ম দিতে অভিভাবকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, শিশুকে যেকোনও শিক্ষা দেওয়ার আগে অভিভাবকদের নিজেদের রুটিন ও অভ্যাস বদলাতে হবে। যখন আমরা রুটিন মানবো না তখন শিশুরা মানবে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। শিশুদেরকে ওয়ান টু ওয়ান সময় দিতে হবে। আমি অন্তত তেমনটাই করি এবং ভালো ফল পাচ্ছি। এর মানে সন্তানের সঙ্গে বসে খেলা দেখা নয়, খেলা করা। ইমোশনটাকে সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত করতে হবে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশু ও অভিভাবকদের মাইন্ড-সেট পাল্টাতে হবে। বন্দি শব্দটা মনে করলেই অস্থিরতা বাড়বে। ফলে মনে করতে হবে শিশু ঘরবন্দি নয়, বরং বাইরের পৃথিবীটা বন্দি, বাইরের পৃথিবীটা আপাতত কারাগার। বরং আমি ঘরে থাকলেই রোগ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ থাকবো।

তিনি বলেন, ১৫/২০ দিন ছুটি কাটানোর পরে আর এই ঘরে থাকাকে ছুটি মনে হচ্ছে না শিশুদের। কিছু করতে পারছি না, স্কুল কলেজ পড়ালেখা নেই এটা না ভেবে সে যেন মনে করে এই ঘরে থাকা মানে নিরাপদ থাকা। অভিভাবকদের সেভাবে পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

কিশোর বয়সী সন্তানদের অবশ্যই করোনার প্রাথমিক বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত করতে হবে উল্লেখ করে এই চিকিৎসক বলেন, পিপিই পরিহিত ব্যক্তিকে যেন ভয় না পায় সেটি শেখাতে হবে। বাবা-মার করোনা হলে যেকোনও সময় তাদের থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে কথা বলতে হবে। সেই আপৎকালীন সময়ে শিশুর বিকল্প অভিভাবক হিসেবে কাদের তত্ত্বাবধানে থাকবেন তাদের সঙ্গেও নিয়মিত ভিডিও কল-এর মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে হবে।

শিশু (2)

ঘর থেকে এই শিশু কিশোরদের বের হওয়ায় অনিরাপদবোধ করছেন কেন এবং করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, 'এখন পর্যন্ত বাইরে যাওয়ার কোনও নিয়মই নেই। অন্তত আরও দেড়মাস আমরা তাদের বাইরে যেতে নিরুৎসাহিত করছি। শিশুকে যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত না করে ব্যবহারের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'শিশুরা দিনের বেলা যেন সক্রিয় থাকে সেই চেষ্টা থাকতে হবে। যেসময় তারা বাইরে যেতো, সেই সময়টায় ঘরে কোনও না কোনও কাজ করবে। বই পড়া, ছবি আঁকা, এমনকি ভিডিও গেমও খেলতে পারে। তবে সেটাও পরিমিত। মূল বিষয় হলো ব্যস্ত থাকা। তবে কোনও কারণে শিশু-কিশোরদের বাইরে যেতেই হলে নতুন পরিস্থিতিতে বাইরের জগৎ ও মানুষ নিয়ে কথা বলতে হবে।'