জলাবদ্ধতার মূল কারণ নিয়ে ২০১৭ সালে একটি সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তাতে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় ৪৩টি খাল ছিল। এসব খালের মধ্যে ২৬টি ঢাকা ওয়াসা ও আটটি ঢাকা জেলা প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর নয়টি খাল বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে। বাকিগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এসব খালে নেই পানিপ্রবাহ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তবে সিটি করপোরেশনের এই প্রতিবেদনের খালের হিসাবের সঙ্গে একমত নন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা জানিয়েছেন খালের সংখ্যা ছিল ৫২টি। বাকি খালগুলোর এখন অস্তিত্ব নেই।
এসব খালের অধিকাংশ স্থানে প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা-অবর্জনা ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় বিলীন হয়ে গেছে অস্তিত্ব। এতগুলো খাল থাকার পরেও রাজধানীর জলাবদ্ধতার কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দখল-দূষণের পরেও যে পরিমাণ খাল রয়েছে সেটাও যদি সচল রাখা যেতো তাহলে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
এসব খাল ও ড্রেন সচল করার জন্য প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও সারফেস ড্রেন নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ব্যয় করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ৭১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এই খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭২ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আদর্শ শহরে ২৫ ভাগ উন্মুক্ত এলাকা ও ১৫ ভাগ জলাধার থাকবে। কিন্তু রাজধানী ঢাকায় উন্মুক্ত এলাকা নেই বললেই চলে। শহরের সিংহভাগই কংক্রিটের ঢালাইয়ে আবদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও বাড়ছে না। আর এই খালি জায়গাগুলোতেও বৃষ্টি পানি যেতে দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক পতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনের পর দিন কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৯-এ এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮২ ভাগে। একই অবস্থা জলজ ভূমিরও। গত বছর এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ ভাগ। এভাবে দিন দিন জলজ ভূমি ও খালি জায়গাগুলো কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যতদিন খাল ও ড্রেন কেন্দ্রিক চিন্তা থেকে সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও ঢাকা জেলা প্রশাসনকে বের করে আনা যাবে না, ততদিন ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর হবে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর খাল ও ড্রেন কেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার কারণেই আজ বৃষ্টি হলে ঢাকা ডুবে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হলে খাল ও ড্রেনের পাশাপাশি উন্মুক্ত জায়গা ও জলাশয় রক্ষা করতে হবে।’
এই পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘এখনও যেসব এলাকা উন্মুক্ত রয়েছে তা রক্ষা করতে না পারলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। রাজউক যদি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় সেখানে কী পরিমাণ জায়গা খালি রাখতে হবে সেটা চিহ্নিত করে দেয় এবং নিয়মিত তদারকি করে তাহলে জলাবদ্ধতার সমস্যা সামাধানের পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও আরও বাড়বে।’
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঢাকার উন্মুক্ত জায়গা নেই বললেই চলে। যে কারণে বৃষ্টি হলেই সেই পানি বাসাবাড়ির ছাদ হয়ে রাস্তায় চলে আসে। এই পানিগুলো আবদ্ধ করে রাখার মতো কোনও উন্মুক্ত জায়গা নেই। যদি থাকতো তাহলে কিছু পানি ভূগর্ভে চলে যেতো। বাকি পানি ড্রেন ও নালা দিয়ে খাল হয়ে আশপাশের নদীতে চলে যেতো। তখন জলাবদ্ধতা হতো না। তাই জলাবদ্ধতা নিরসনে কৃত্রিমভাবে ড্রেন নির্মাণ করে সেগুলো সচল রাখতে হচ্ছে।’
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু তারা সেই কাজ করছে না। তারা খাল ও ড্রেন নিয়ে বসে আসে। আমরা খালগুলোকে আমাদের আন্ডারে দেওয়ার জন্য দাবি করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে মিরপুরের সাংবাদিক খালের সমস্যা অনেকাংশে দূর করেছি। বিমান বন্দর থেকে কাওনা পর্যন্ত এলাকার খাল পুনঃ উদ্ধার করে সেই এলাকার সমস্যা দূর করেছি।’