গতবছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। এজন্য কলকাতা ও সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাও নিয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলাদা বিভাগ চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও তার সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। তবে এ বছর দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন কাজে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। বাড়িয়েছে এ খাতের বরাদ্দও। এর পরেও ডেঙ্গু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, দুই ধরনের পরিকল্পনা দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সিটি করপোরেশন। প্রথমত বছরব্যাপী, দ্বিতীয়ত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনাটি যাচাই-বাছাই চলছে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় ও মেয়রের নেতৃত্বে পাঁচটি সভা হয়েছে। সেখান থেকে এ ব্যাপারে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বছরব্যাপী কর্মপরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতিদিন সকাল-বিকাল ৪ ঘণ্টা করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। পাশাপাশি বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা চিরুনি অভিযানও পরিচালনা করা হচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে বরাদ্দ, যান, যন্ত্রপাতি ও কর্মী বাহিনী।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে আসছে। এরপরও আমরা বসে নেই। গত মে ও জুন মাস মশা নিধনে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করেছি। প্রতি ওয়ার্ডকে ১০ ভাগে ভাগ করে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। প্রতিটি ভাগে ৫ জনের একটি দল স্থাপনা পরিদর্শন করছে। এই অভিযানে স্বাস্থ্য অধিদফতর, কীটতত্ত্ববিদেরা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এছাড়া হাসপাতালগুলোতেও এখন দ্বিতীয় দফায় ওষুধ ছিটানোর কাজ চলছে।
ডিএনসিসি সূত্র জানিয়েছে, মে মাসে প্রথম ধাপে ১০ দিনব্যাপী চিরুনি অভিযান করা হয়। তখন ৯ হাজার ৪৬৩টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১ দশমিক ৯৮ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। এর আগে গত ৫ জুন থেকে ১৫ জুন ১০ দিনে প্রথম দফায় সংস্থার ৫৪টি ওয়ার্ডে ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩৫টি বাড়ি পরিদর্শন করে ১ দশমিক ১৯ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। চিরুনি অভিযানে প্রায় ৬৭ শতাংশ স্থাপনায় এডিসের বংশ বিস্তারের উপযোগী পরিবেশ দেখা গেছে। প্রায় ১ দশমিক ২ শতাংশ স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া গিয়েছিল। আর জুলাই মাসে ১ লাখ ৩০ হাজার ৯৭৭টি বাড়ি পরিদর্শন করে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। এই অভিযানে ৫৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা উপযোগী পরিবেশ পাওয়া গেছে।
এদিকে নগরজুড়ে ডেঙ্গুর ঘনত্ব নির্ণয় করতে গত ১৯ জুলাই থেকে জরিপ কাজ পরিচালনা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অভিযানের প্রথম তিন দিনে ৩০০টির মতো বাড়ি পরিদর্শন করা হয়। এসময় ৪৫ শতাংশ বাড়িতে এডিসের লার্ভা পান জরিপকারীরা।
দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আগে সকাল এক ঘণ্টা লার্ভিসাইডিং ও বিকেলে এক ঘণ্টা অ্যাডাল্টিসাইডিং করা হতো। আমরা এখন থেকে সেটাকে ৪ ঘণ্টা করেছি। তখন মশক নিধন কাজে ছিল শুধু ফাঁকি আর ফাঁকি। এখন ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিত করে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে এখন মশার উপদ্রব অনেক কমেছে। আমরা আশা করছি এ বছর ঢাকাবাসীকে ডেঙ্গু থেকে মুক্ত রাখতে পারবো।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাস ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নাগরিকদের সচেতন করা এবং এডিস মশার বংশবিস্তারের স্থান নিয়ন্ত্রণ করা না হলে করোনা মহামারির মধ্যেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বড় আকারে দেখা দিতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম দিন থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত রাজধানীতে ৩৩৮ জন আক্রান্ত হয়েছে। আর ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ১৯৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪৫ জন, মার্চে ২৭ জন, এপ্রিলে ২৫ জন, মে মাসে ১০ জন এবং জুনে ২০ জন এবং জুলাইয়ে গত ২১ জুলাই পর্যন্ত ১২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এদিকে ৫টি মাতৃসদন ও ৩৫টি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তাতে ২১৬ জন পরীক্ষা করা হয়েছে। এরমধ্যে ৯ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক ড. কবিরুল বাশার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডেঙ্গুর পিক টাইম হচ্ছে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর। এবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয়েছে। কিন্তু এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসে এসে এর সংখ্যা একেবারেই কমে গেছে। আসলে এটাতে সন্তুষ্ট থাকার কোনও কারণ নেই।
তিনি এর কারণ উল্লেখ করে বলেন, গত ৮ মার্চ যখন দেশে প্রথম করোনা রোগী ধরা পড়ে ঠিক তখন থেকে আইইডিসিআরের তথ্যে ডেঙ্গু রোগী কমতে থাকে। এর অন্যতম কারণ হয়তো ডেঙ্গুর লক্ষণ জ্বর, করোনা রোগেরও লক্ষণ। মানুষের জ্বর হলে তখন তারা তেমন একটা ডেঙ্গুর পরীক্ষা করতো না। হাসপাতালগুলোও শুধু করোনা টেস্ট করে থাকতো। করোনা টেস্ট ছাড়া কেউ ডেঙ্গুর চিকিৎসা করতো না। মানুষও হাসপাতালে যেতে চায় না, হাসপাতালগুলোও তেমন একটা জ্বরের রোগী নেয়নি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আকতার মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যে কোনও বিষয়ে শুধু সিটি করপোরেশনের মেয়রদের দিকে তাকিয়ে থাকলে কোনও শহরের জন্য ভালো কিছু হবে না। ঢাকার দুই শহরে ১২৯ জন কাউন্সিলরের পাশাপাশি এর এক তৃতীয়াংশ নারী কাউন্সিলরও রয়েছে। তারা হচ্ছে স্থানীয় সরকারের শেষ প্রান্ত। তারাই সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু। তারা ছোট একটা এলাকার দায়িত্বে থাকেন। তাদের সঙ্গে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন বা সমিতি ও রাজনৈতিক দল থাকে। এরা সবাই মিলে যদি সংগঠিত হয় যে কোনও দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব। শুধু সিটি করপোরেশনের কেন্দ্রীয় অফিস বা একজন মেয়রকে দিয়ে কোনও ভাবেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জনগণ যদি যে যার অংশ দেখে তাহলে ডেঙ্গুর মতো পরিস্থিতি আবার আসবে না। কারণ সিটি করপোরেশনের পক্ষে কার বাড়ির কোথায় মশার লার্ভা আসে সেটি দেখা সম্ভব নয়। যদি বাড়ি মালিক বা বাসিন্দারা সেটি না দেখেন। এ জন্য এসব কাজে সবার আগে নাগরিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটির চারটি ওয়ার্ডে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনোমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম-সিপ। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির উপ-নির্বাহী পরিচালক তাহমিনা জেসমিন মিতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নাগরিক সম্পৃক্ততা বাড়ানো প্রয়োজন। কারণ সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে এ ধরনের কাজ বাস্তবায়ন করা কঠিন। তাই আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা কাউন্সিলরদের সম্পৃক্ত করে এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে মাইকিং, লিফলেট, স্টিকার বিতরণ, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর তথ্য সংগ্রহ করে মশকনিধনসহ নানা কাজ বাস্তবায়ন করছি। যাতে মানুষ সচেতন হন। এছাড়া চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি মিরপুরের কিংস্টোন হাসপাতালে বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ড গড়ে তুলেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার রোধে পরীক্ষামূলক একটি নজরদারি পদ্ধতি গড়ে তুলেছি। কোথাও কোনও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলেই সেখানকার আশপাশে ৪০০ বর্গ মিটারজুড়ে প্রকল্পের পক্ষ থেকে মশা নিধন করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের জন্য মশারি বিতরণ করা হয়েছে।