পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বন্দিদশা থেকে ‘মুক্ত’ ১১ প্রবাসীর!

 

ইয়েমেনে আটক ব্যক্তিদের ছবি

দেড় বছরেরও বেশি সময় পাকিস্তানের করাচির ল্যান্ডি জেলখানায় বন্দি থাকা ৮ বাংলাদেশি মুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। তবে তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। মাইগ্রেশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আটক ব্যক্তিরা মুক্তি পেলে সবার আগে পরিবারের সঙ্গেই যোগাযোগ করেন। যোগাযোগ না করাতে বোঝা যায় যে তারা মুক্তি পাননি।

বৈধ ভিসায় ওমান গিয়েছিলেন নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ৮ বাসিন্দা। তারা ওমান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী সাগরে মাছ ধরতে গেলে ইঞ্জিন বিকল হয়ে স্রোতের টানে পাকিস্তানের জলসীমায় ঢুকে পড়েন। আটক হন পাকিস্তান নৌবাহিনীর হাতে। তিন মাসের জেল হয় তাদের। কিন্তু কারাদণ্ড ভোগ করেও মুক্তি পাননি। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাদের মুক্তিতে বাধা নেই বলে আদালত রায় দিলেও তারা আটকই ছিলেন। কারণ তাদের কাছে তখন ছিল না কোনও পাসপোর্ট।

এ নিয়ে গত ২৮ জুন ‘পাকিস্তানের কারাগারে শিকলবন্দি ৯ বাংলাদেশি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলা ট্রিবিউন। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অস্বীকার করলেও প্রতিবেদন প্রকাশের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সংবাদ সম্মেলন করে জানান, পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশিদের ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেনে, সংবাদ দেখার পর আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করি। তারা আমাদের জানিয়েছে আটককৃতরা বাংলাদেশি নাগরিক। আমরা সঙ্গে সঙ্গে মিশনকে জানিয়েছি তাদের নিয়ে আসার জন্য। করোনার কারণে ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। ফ্লাইট চালু হলে তারা ফেরত আসতে পারবে।

ওই ৯ ব্যক্তি হলেন−নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের চরহেয়ার গ্রামের ছাইদুল হকের ছেলে মো. নবীর উদ্দিন, সোনাদিয়া ইউনিয়নের বাংলাবাজার এলাকার আবু তাহেরের ছেলে মো. শাহরাজ, নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের নামারবাজার বন্দরটিলা এলাকার গিয়াস উদ্দিনের ছেলে ইউসুফ উদ্দিন, নলচিরা ইউনিয়নের ৩নং রানী গ্রামের মো. এছহাকের ছেলে মো. আবুল কাশেম, জাহাজমারা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের আবুল কাশেমের ছেলে মো. শরিফ, একই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদু মিয়ার বাড়ির খবির উদ্দিনের ছেলে মো. সাহেদ ও ৩নং ওয়ার্ড চরহেয়ার গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে মো. খান সাব, লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার ৬নং পাটারীরহাট ইউনিয়ন পরিষদের ১নং ওয়ার্ড পশ্চিম চর ফলকন গ্রামের দ্বীন মোহাম্মদের ছেলে মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন ও একই জেলার রামগতি উপজেলার সেবা গ্রামের মো. রফিকের ছেলে মো. ফারুক মিয়া।

ওই বছরের ৯ আগস্ট পাকিস্তানে অবস্থানরত বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আটক ব্যক্তিদের নাম, ঠিকানা ও প্রিভিয়াস কনভিকশন অ্যান্ড প্রিভিয়াস রেকর্ড (পিসিপিআর) যাচাই করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন।

১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসসিও) নোয়াখালী জেলার ৮ ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, নাগরিকত্ব, পিসিপিআর, থানা রেকর্ডপত্র, অপরাধ তথ্য এবং জঙ্গি সম্পৃক্ততার তথ‌্য আছে কিনা তার বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠাতে নোয়াখালী পুলিশ সুপারকে পত্র দেন। ওই মাসের ২৪ তারিখে এসব ব্যক্তির নাম ও ঠিকানা যাচাই করে ফেরত পাঠান নোয়াখালী পুলিশ সুপার। তাতে বলা হয়, আটক ব্যক্তিরা জন্মসূত্রে বাংলাদেশি। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগ নেই।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। ওরা এখন জেল থেকে বের হয়েছে। তাদেরকে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য টাকাও পাঠিয়েছি। আশা করছি যখনই ফ্লাইট চালু হবে তখনই ফিরিয়ে আনা হবে।

পাকিস্তানে আটক ব্যক্তি

আটক নবীর উদ্দিনের ছেলে ছারোয়ার উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাবা বিদেশ যাওয়ার পর দীর্ঘদিন কোনও যোগাযোগ নেই। হঠাৎ পুলিশ ভেরিফিকেশন আসার পর বিষয়টি জানতে পারি। নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করি। মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় ঘুরতে থাকি। কোনও সাড়া পাইনি। বাংলা ট্রিবিউনে প্রতিবেদন প্রকাশের পর মন্ত্রী মহোদয় তাদের আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এখন যদি তারা জেল থেকে বের হয়ে থাকেন তাহলে কেন আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না? আমার আব্বাসহ অন্যরা যদি মুক্ত থাকেন তবে কারও না কারওর সঙ্গে তো যোগাযোগ হতো। দিন যত যাচ্ছে আমরা আশাহত হচ্ছি। স্বজনদের ফিরিয়ে আনতে যদি আরও টাকা লাগে প্রয়োজনে সেটাও দেবো।

হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. শাহরাজের বাবা আবু তাহের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ছেলে ৬ মাস বা এক বছর পরে আসুক তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা তার সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই। গত ১৭ মাস তার সঙ্গে আমাদের একবারও কথা হয়নি। এখন ছেলে বেঁচে আছে কিনা সেটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। আমাদের দাবি অন্তত এক মিনিটের জন্য ছেলের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিক।

ইয়েমেনে আটক তিন বাংলাদেশি

এদিকে ইয়েমেনে আটক রয়েছে তিন বাংলাদেশি। তালিকায় আছেন চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইউসুফ, পেশায় বাবুর্চি। তার পাসপোর্ট নং বিএইচ ০৩৫৪৭৫৮। আছেন মোহাম্মদ আবু তাইয়ুব (পাসপোর্ট নং- বিএক্স ০৮৫৬৮৭৪) এবং মোহাম্মদ রহিম উদ্দিন (পাসপোর্ট নং ইএফ ০০১০১৩০)।

এদের মধ্যে রহিম উদ্দিনের স্ত্রী সাইফুন নাহার মনি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। তার আবেদনে জানা যায়, তার স্বামী বৈধভাবে ওমানের সুলতান অ্যান্ড সুলতান মোহাম্মদ কোম্পানির অধীনে ওমানে যান। গত ৩ ফেব্রুয়ারি কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় সৈদি আরবের ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট নিয়ে আরও সহকর্মীসহ জাহাজে করে সৌদি আরবে যাওয়ার পথে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় একটি জাহাজ ইয়েমেন সাগরে ডুবে যায়। বাকি দুটি জাহাজের সহযোগিতায় ডুবে যাওয়া জাহাজের সহকর্মীরা প্রাণে রক্ষা পেলেও ইয়েমেনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রহিম উদ্দিনসহ সকল ক্রুকে আটক করে সানা হোটেলে রাখে। সেখানে তারা এখন মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন।

জানতে চাইলে ব্র্যাকের হেড অব মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আটক ব্যক্তিরা যদি জেল থেকে বের হন তবে তাদের কেউ না কেউ তো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তা না করায় তারা মুক্তি পেয়েছেন কিনা তাতে সন্দেহ দেখা যাচ্ছে। এসব প্রবাসীকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা উচিত। সরকার চাইলে কূটনৈতিক তৎপরতায় এসব ব্যক্তিকে দ্রুত ফেরত আনতে পারে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে আরও মানবিক হওয়া উচিত।