১৯৭২ সালের পত্রিকার পাতা বিশ্লেষণ করে ইতিহাসবিদরা বলছেন, তখন একদিকে চলছে যারা ফিরে আসেনি তাদের খবর প্রকাশ, আরেকদিকে দেশ গড়তে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সেই সংবাদ। তারা বলেন, সেসময়ের সংবাদপত্রগুলো আমাদের ইতিহাস লিখতে ভূমিকা পালন করেছে। তাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেছে।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের দৈনিক বাংলা পত্রিকার প্রধান খবর ছিল ‘আজ বিজয় দিবস: আজ সংবিধান চালু হলো’। নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণ করলেন শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে নিয়াজির আাত্মসমর্পণের যে ইতিহাস তা প্রকাশিত হয় আর সঙ্গে রেসকোর্সে সবাই সেদিন যেভাবে ছিল তার একটি স্কেচ এঁকে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া কিভাবে মুজিব পরিবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন সে নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছিল শেষের পাতায়। মুনতাসির মামুন বলেন, তখনই ইতিহাস লেখা শুরু হয়ে গেছে। তারা যে তথ্যগুলো সামনে আনছিল সেগুলোকে প্রাথমিক তথ্য বিবেচনা করেই বহু ইতিহাসের বই লেখা হয়েছে। তারা যদি সময়টাকে ধরতে না পারতো তাহলে অনেককিছুই হারিয়ে যেত।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ব সাব্বির হোসাইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারে ৭২-এর পত্রিকাগুলো প্রসিকিউশন ডকুমেন্টারি এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির বিরুদ্ধে পাকিস্তান, বিহারি ও দালালদের বর্বরতা, মুক্তিযুদ্ধের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি জানার ও বুঝবার জন্য ৭২'এর পত্রিকাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময় সাংবাদিকরা সারাদেশ থেকে প্রত্যক্ষদর্শী ও নিপীড়িতদের বক্তব্যকে ভিত্তি করে পাকিস্তানি বর্বরতার ওপর প্রতিবেদন করেছিলেন। এই প্রতিবেদনগুলো মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রাথমিক তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস বলে বিবেচিত হয়।
ওমর শেহাব বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পত্রিকাগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বুঝতে ও পরবর্তীতে বিস্তারিত লিখতে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছিল সে বিষয়ে বলতে গিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টির ডক্টরাল ক্যান্ডিডেট ও ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম-এর সদস্য ওমর শেহাব বলেন, পুরনো পত্রিকাগুলো আমাদের প্রজন্মের মানুষদের কাছে স্বর্ণখনির মতো। অনেকেই জানে না স্বাধীনতার পর পর ঈদের ছুটি আর পূজার ছুটি ছিল সমান। খসড়া সংবিধান- যার একটি মূলনীতি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা- মানুষের মতামতের জন্য সেটা পত্রিকায় ছাপানোও হয়েছিল।
স্বাধীন হওয়ার জন্য আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রচেষ্টার শুরু যে পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে, আবার বিজয়ের প্রথম বার্ষিকীর বিজ্ঞাপনগুলো ছিল সৃজনশীলতা আর দেশপ্রেমের অনন্য প্রদর্শনী। এই ব্যাপারগুলো আমরা জানতে পারব যদি আমরা ওই পত্রিকাগুলোতে চোখ বুলানোর সুযোগ পাই।
দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আরও বলেন, পত্রিকাগুলো জাতীয় আর্কাইভ আমাদের জন্য অনলাইনে দিতে পারে। জাতীয় আর্কাইভের এটি স্থায়ী সমৃদ্ধ ইউনিট থাকা উচিৎ যেটি নিয়মিত এই সব পত্রিকা অনলাইনে সংরক্ষণ করবে। আশা করি সরকার খুব দ্রুত এর জন্য অর্থ বরাদ্দ করবে ও পদ সৃষ্টি করবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর শাহীদুর রহমান বলেন, এই পত্রিকাগুলো আমাদের তদন্তে অনেক ভূমিকা রেখেছে। এগুলো এত তথ্যবহুল যে এগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেমন জরুরি তেমনই এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও জরুরি। এতে ইতিহাস বিকৃতির যে প্রচেষ্টা ১৯৭৫ সালের পর দীর্ঘসময় ধরে হয়েছে সেটা আবার মাথাচাড়া দিতে পারবে না।
গণমাধ্যম বিশ্লেষক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, সাংবাদিকতায় যে ধরনের লেখালেখি বা কথা বলা হয়, তার পুরোটা জুড়েই থাকে তথ্য, আর সেই তথ্য উপস্থাপিত হয় কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বড় কনটেক্সট আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তাকে বাদ দিয়ে ইতিহাস, রাজনীতি এমনকি অর্থনীতি বিষয়ে সাংবাদিকতা করা অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের পরপর পত্র পত্রিকায় সেই কনটেক্সটকেই তুলে ধরার প্রয়াস ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইতিহাসের চাকা পেছনের দিকে নেওয়ার যে চেষ্টা হয়েছিল তার সঙ্গে ছিল গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে নিষিদ্ধ করে রাখা। সে কারণে ইতিহাস বিকৃতি বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, নতুন করে যে প্রয়াস আমরা দেখছি, তাতে গুটিকয়েক গণমাধ্যম নতুন করে আবার সেই প্রচেষ্টায় আছে। কোনও মাধ্যমে খবর বা খবর বিষয়ক অন্যান্য কনটেন্ট থাকলেই তাকে গণমাধ্যম বলা যায় না। ইনফরমেশন, এডুকেশন, কমিউকেশনের যে ধারণা নিয়ে গণমাধ্যমের বিচরণ সেখানে সাংবাদিকতা গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না।
ছবি কৃতজ্ঞতা: সিবিজিআর ও আইসিএসএফ
/এফএ/আপ-এসএম