বড়দিনের উৎসবে যত বিবর্তন

87550304365c8eee56cec86067740fa3-5e023f7c8e274

উপমহাদেশে বড়দিনের উৎসবকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি যুগে যুগে হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা শুরুর পরের সময়ে তাকালে মনে হতে পারে, শুধু ক্রিসমাস ট্রি সাজানো আর সান্তাক্লজের উপহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উদযাপন।
একসময় বড়দিনকে সামনে রেখে কীর্তন বা ক্রিসমাস ক্যারলের প্রস্তুতি দেখা যেতো। সেই চিত্র হারিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। স্বল্প পরিসরে সামান্য কিছু জায়গায় কীর্তন হলেও তা বিলীন হয়ে যাবে বলে শঙ্কা করেন যিশুখ্রিষ্টের অনুসারীরা। গ্রামে ও শহরে বড়দিনে ব্যাপক আকারে ভেড়ার মাংস ভোজের প্রচলন থাকলেও এই রীতি এখন অনেক কমে গেছে। তাছাড়া ঘরে আল্পনা দেখা যায় না বললেই চলে। 

খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সবার কাছে বড়দিন একটি পুণ্যময় দিন। যিশুখ্রিষ্টের জন্ম কবে হয়েছিল তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই পবিত্র বাইবেলে। খ্রিষ্টধর্মের প্রবর্তক জন্ম নিয়েছিলেন অলৌকিকভাবে। পৃথিবীর সব পাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে আরও সুসংহত করতেই তাঁর আবির্ভাব। যিশুর আগমনের এই ক্ষণ স্মরণ করতেই অনুসারীরা বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন উদযাপন করে থাকে।

যেভাবে এলো ক্রিসমাস ট্রি

খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের লোকজন পুরনো অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করতে গিয়ে উল্লেখ করেন, ক্রিসমাস ট্রি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি নয়। এই গাছ সবখানেই পাওয়া যায় তাও নয়।

লুসি গোমেজ নামের একজন বলেন, ‘একসময় বাড়ির উঠানে কলাগাছ পুঁতে সেটিকে কেন্দ্র করে রঙিন বেলুন সাজানো হতো। ছোট গাঁদা ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে ফটক বানাতে দেখা যেতো। কিংবা ঘরের উঠানে রাখা হতো। ঘরে ঘরে টেলিভিশন জায়গা নেওয়ার সঙ্গে ক্রিসমাস ট্রি যুক্ত হয়ে যায় বড়দিনে। তবে এখনও গাছটি সহজলভ্য না হওয়ায় বাসায় প্লাস্টিকের গাছ এনে সাজানো হয়।’

বড়দিনে পিঠাই ছিল কেক

বড়দিনের কাছাকাছি সময়ে নতুন ফসল ঘরে ওঠে। ফলে হরেকরকম পিঠা ছিল উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। এখনকার মতো কেক আমাদের দেশের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এত জনপ্রিয় ছিল না। একসময় পিঠাই ছিল প্রধান খাবার। ধীরে ধীরে পিঠা কীভাবে কেক হয়ে গেলো তা স্বল্প কথায় জানিয়েছেন বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের খ্রিষ্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব নির্মল রোজারিও। তিনি বলেন, ‘একসময় বড়দিনে ভাওয়াল অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বিবিক্কা পিঠার জনপ্রিয়তা ছিল। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে কেক। পশ্চিমা বিশ্বের দেখাদেখি সব দেশেই বড়দিনে কেকের প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। শহুরে আয়োজনে আগে থেকেই কেক থাকলেও এখন তা গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।’

f6a1de4c798e35e548e236f41562e140-5e02408f36583আল্পনা নেই কেন

বাড়ির ধরনের কারণে হারিয়ে গেছে আল্পনা। একসময় বড়দিনে গ্রামীণ বাড়িতে মাটির দেয়ালে কিংবা কাদামাটি দিয়ে বেড়া লেপন করে নানান রঙের নকশা-ফুল আঁকা হতো। হালকা লাল রঙা ও সাদার কারুকার্যে ফুটে উঠতো উৎসবের আগমন। কিন্তু এখন আর মাটির ঘর নেই। এ কারণে গ্রামবাংলায় আল্পনা দেখা যায় না। শহুরে সংস্কৃতিতে খুব ছোট পরিসরে কেউ আল্পনা আঁকলেও বাসার মধ্যে তা সীমিত থাকে। যদিও কাগজের ঝালোর দিয়ে ঘর সাজানোর রীতি এখনও আছে।

ক্রিসমাস ক্যারল বা কীর্তন কেন নেই

একসময় বড়দিন মানেই ছিল কীর্তন গানের প্রস্তুতি। ১০-১২ দিন ধরে শিশু-কিশোররা সম্মিলিত কণ্ঠে সংগীত পরিবেশনের জন্য মহড়া করতো। গ্রামে গ্রামে এমনকি শহরেও ছিল এই আয়োজন। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে গাওয়া হতো কীর্তন। এমনকি ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর রাতে যিশুর অনুসারীরা সম্মিলিতভাবে ঘুরে ঘুরে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যেতো। প্রায় সারারাত জেগে গাওয়া হতো কীর্তন গান, চলতো ভোর পর্যন্ত। গান পরিবেশনের পর হইচই করে প্রতিটি বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া হতো। সেসব আনন্দ এখন আর চোখে পড়ে না। আবহমান কালের এই কীর্তন গান বিলুপ্তপ্রায়।

বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসই মূল কারণ

জীবিকার জন্য মানুষ বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়েছে। একই স্থানে সবার একসঙ্গে বসবাসের সুযোগ কিংবা যৌথ পরিবার প্রথা যত কমেছে, বড়দিনের আনুষ্ঠানিকতায় তত পরিবর্তন এসেছে। এ কারণে হারিয়ে গেছে বৈঠকও। আগে গ্রামাঞ্চলে বাড়িতে বাড়িতে বৈঠক বসতো। বড়দিনের আগে কয়েকদিন ধরে এই আয়োজনে গান-বাজনাসহ বিভিন্ন পিঠাপুলি ভাগাভাগি করে একসঙ্গে খাওয়া হতো। কিন্তু এখন সবাই একত্র হতে না পারার কারণে বৈঠকের পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে পালাগান, কীর্তন প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন আঞ্চলিক নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

উৎসবের বিবর্তন বিষয়ে নির্মল রোজারিও বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একসময় গ্রামেগঞ্জে ঢোল বাজিয়ে কীর্তন হতো, সেটি এখন ক্রিসমাস ক্যারলে রূপ নিয়েছে। তারপরও যে কীর্তন একেবারেই হয় না তা নয়। তবে এর ধরনে পরিবর্তন এসেছে। বৈঠকের কথা না বললেই নয়। সবাই মিলে তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমাজ ছিল। পিঠা খাওয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে উৎসব আয়োজন হতো। বাস্তবতার কারণে এখন সেই গোষ্ঠীগত উৎসব ধীরে ধীরে একান্নবর্তী পরিবারের মতো বিচ্ছিন্ন উৎসব যাপনে রূপ নিয়েছে।’