একসময় ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা হতো বলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নাম ছিল রেসকোর্স ময়দান। ৪১০ বছরের পুরনো এই ময়দানে কালের বিবর্তনে এসেছে নানা পরিবর্তন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথমে শিখা চিরন্তন এবং পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত স্থাপনা এবং স্থান পেয়েছে ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যুরাল। আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষায় এবং নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস পৌঁছানোর জন্য স্বাধীনতা জাদুঘর। সামনেই কৃত্রিম জলাশয়। সম্প্রতি এই উদ্যানের অধিকতর উন্নয়ন কাজে গাছ কাটার খবরে আবারও আলোচনায় আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনের ‘নতুন পরিকল্পনা’। আবারও এটিকে আদালত অবমাননা উল্লেখ করে মামলাও করা হয়েছে।
এ সময় থেকে রমনা রেসকোর্স গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাবেশের স্থানে পরিণত হয়। ১৯৭৫ সালের পর এলাকাটিকে সবুজে ঘেরা পার্কে পরিণত করা হয়। পার্কের একপাশে শিশুদের জন্য একটি বিনোদন কেন্দ্র তথা পার্ক গড়ে তোলা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলোকে স্মরণীয় করে রাখার লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে এখানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করা হয়েছে। একইসঙ্গে তার পাশেই যেখানে পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেছিল, সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ। স্বাধীনতা স্তম্ভের পাশেই রয়েছে একটি স্বচ্ছ পানির লেক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তৈরি হয়েছে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড জাদুঘর।
পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, পশ্চিম ও পূর্ব পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য কাজ চলছে। পাশপাশি কিছু স্থাপনা নির্মাণেরও কাজ চলছে। সেসব জায়গায় কিছু গাছ কাটার নমুনা দেখা গেছে। তবে তা সংখ্যায় ৪ থেকে ৫টি। গাছগুলো ওয়াকওয়ের পাশ ঘেঁষে যাওয়ায় কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। কয়েক জায়গায় আবার সাইনবোর্ডও টানানো আছে। তাতে লেখা— ‘ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতাস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় উদ্যানের সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিকল্পিত সবুজায়ন ও পরিবেশ উন্নয়নের কাজ চলমান। সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য।’
স্বাধীনতা জাদুঘর থেকে কিছুদূর সামনেই রয়েছে একটি উন্মুক্ত জলাশয়। সেখানে অনেকগুলো গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়েছে। সেগুলো মূলত পামগাছের। সেখানে অবস্থানরত লোকেরা জানান— বজ্রপাতের সময় অনেক পাম গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মাঝখান দিয়ে ফেটে যায়। সিটি করপোরেশনের লোকজন সেগুলো কেটে এভাবেই ফেলে রাখে। তাছাড়া এখানে মাটি কেটে রাখা হয়েছে ড্রেন তৈরি করার জন্য।
পুরো উদ্যান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উদ্যানের বেশকিছু গাছে লাল রঙ দিয়ে ক্রসচিহ্ন দেওয়া। তবে এটি কারা করেছে সে সম্পর্কে কিছেই জানা যায়নি। গণপূর্ত বিভাগ বলছে, এটি আন্দোলনকারীদের কাজ। এ বিষয়ে জানতে খোঁজ করা হলেও সেই সময় আন্দোলনকারীদের কাউকেই সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়নি। তবে সেখানে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে কিছু ব্যানার টানিয়ে রাখা হয়েছে। তবে পুরো উদ্যান ঘুরে রবিবার কোনও গাছ কোটতে দেখা যায়নি।
আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদের কারণে সরকারের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সেখানে কিছু গাছ কাটা হলেও প্রায় এক হাজার গাছ লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
গণপূর্ত মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘‘পরিবেশবাদীদের বক্তব্য পুরোপুরি ঠিক নয়। তারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো বানাতে উদ্যানের জমি কোথাও উঁচু কোথাও নিচু করতে হবে। তা করতে কোথাও মাটি ভরাট করতে হচ্ছে। আবার কোথাও মাটি কেটে গভীর করতে হচ্ছে। এর জন্য ‘না কাটলেই নয়’— এমন কিছু গাছ কাটা পড়ছে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সৌন্দর্য ও সবুজের সমারোহ ঠিক রাখতে ১৩শ’ নতুন গাছ তো লাগানো হচ্ছে। এগুলো লাগানো সম্পন্ন হলে উদ্যান ভবিষ্যতে আরও সবুজ হবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল্লাহ খন্দকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনও হোটেল বানানো হচ্ছে না। আন্দোলনকারীরা যা বলে মানববন্ধন করছেন, তা পুরোপুরি অসত্য। তারা এক ধরনের গুজবই ছড়াচ্ছেন বলা যায়। এখানে বাঙালি জাতির ইতিহাস সমৃদ্ধ কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। এটি পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। দেশে ও দেশের বাইরের মানুষদের বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দেবে। এটি হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জীবন্ত দলিল। পাশাপাশি এখানে শিশুপার্কও থাকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘একজন দর্শনার্থী বা আপনার সন্তান এই বিশাল উদ্যানের বিভিন্ন স্থাপনা দেখে যখন ক্লান্ত হবেন, তখন পানি খেতে তিনি কোথায় যাবেন? সেটা বিবেচনা করে কয়েকটি কফিশপ ও স্ন্যাক্সের দোকান নির্মিত হচ্ছে, যা প্রকল্পেরই অংশ।’
এদিকে গাছ কাটা বন্ধে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে কয়েকটি সংগঠন। এছাড়া আদালত অবমাননার দায়ে মামলাও হয়েছে। গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে।