ডিজিটাল উপকূল- ১

উপকূলের আঁধার কাটালো সৌরবাতি

একসময় উপকূলীয় জনপদ মানেই ছিল সন্ধ্যার পর ঘুঁটঘুঁটে আঁধার। দুর্গম চর আর গ্রামের মেঠোপথ ছিল পথচারীর আতঙ্ক। গ্রামের হাট থেকে বাড়ি ফিরতে হতো দলবেঁধে। টর্চলাইট আর হারিকেনই ছিল যাত্রাপথের ভরসা। সেদিন ফুরিয়েছে। এখন টর্চলাইট-হারিকেন দেখাই যায় না। উপকূলীয় জনপদে এখন জ্বলছে স্ট্রিট লাইট। সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত প্রতিটি গ্রাম। সন্ধ্যা নামলেও সড়ক, হাট-বাজার ও মেঠোপথ থাকে আলোয় আলোয় ভরা।

ভোলার জনপদ চরফ্যাশন। সৌর বিদ্যুতের আলো এখানকার প্রতিটি জনপদে। গ্যাসচালিত বিদ্যুতের ওপর চাপ কমাতে উপজেলার হাট-বাজারসহ রাস্তার পাশে স্থাপন করা হয়েছে এলইডি স্ট্রিট লাইট। সন্ধ্যা নামতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলে উঠছে বাতি। লোডশেডিংয়ের ঝামেলা নেই। বাতিগুলো আলো দেয় সারা রাত। এতে কমেছে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ।

IMG-4279জানা যায়, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি টিআর ও কাবিটার আওতায় উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ও সড়কে সৌর বিদ্যুতের সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১ম ও ২য় পর্যায়ে ২১টি ইউনিয়নে এক হাজার ৪৮৩টি সড়কবাতি স্থাপন করা হয়।

একই প্রকল্পে বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির, স্কুল, কলেজসহ দুস্থ পরিবারে এক হাজার ৮০৩টি সোলার হোম সিস্টেম লাগানো হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ৭৮ লাখ ৪ হাজার ৬৬০ টাকা। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় আরও সোলার বাতি বসানোর স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার’ যেন বাস্তব রূপ পেয়েছে চরফ্যাশনে।

সরেজমিন দেখা গেলো, উপজেলার দ্বীপচর কুকরি-মুকরির দক্ষিণে মনুরা বাজারে যাওয়ার পথে মনির হোসেনের দোকানের সামনে আলো ছড়াচ্ছে সড়কবাতি। আমিনপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের আশপাশের রাস্তাতেও সন্ধ্যার পর ঝকঝকে আলো। এ ছাড়া উপজেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও লাগানো হয়েছে স্বয়ংক্রিয় সৌরবাতি।

্শর রিফপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ‘এত দূরের মানুষ যে এই সুবিধা পাবে কল্পনাও করিনি। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এখন কমেছে। আগে অন্ধকার রাস্তায় হাঁটাচলা করতে ভয় পেতাম। এখন মনে হয় শহরেই থাকি।’

উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সৌরবাতি বসানোর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। এখন রাতেও মানুষ নিরাপদে চলাচল করছে।’

উপকূলের আরেক দুর্গম দ্বীপ হাতিয়া। ছোট-বড় ১৯টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এ উপজেলার আয়তন পনেরশ’ আট বর্গকিলোমিটার। দ্বীপের মূল ভূখণ্ড নলচিরা ঘাট থেকে উপজেলা সদর হয়ে নিঝুমদ্বীপ খেয়াঘাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটার সড়ক। কয়েকদিন আগেও সড়কটি ছিল দুর্গম। সূর্যাস্তের সঙ্গেই বাজারগুলো জনশূন্য হয়ে পড়তো। সেই চিরচেনা চিত্র আর নেই। গ্রামের বাজার এখন খোলা থাকে রাত ১২টা পর্যন্ত। সৌরবিদ্যুতের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।

হাতিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান মাহবুব মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একসময় সন্ধ্যা নামলে হাতিয়ার মানুষ ভয়ে বাজারে যেতো না। চিত্র পাল্টেছে। সড়ক ও হাটবাজারে অসংখ্য বাতি বসিয়েছি। এখানকার অর্থনীতির চাকা এখন আগের চেয়ে সচল।’

সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার সদর ওছখালী থেকে শুরু করে দুর্গম গ্রাম ও আশপাশের চরগুলোতেও সন্ধ্যায় আলো থাকে। গ্রামের অনেকে ওই আলোতে সন্ধ্যার পর আড্ডাও দেন। কেউ কেউ বসিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ দোকানপাট। বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপের মানুষ গ্রিডের বিদ্যুতের আওতায় না আসলেও সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন অনেকে। বয়ারচর, নলেচর, ক্যারিংচর, ঢালচর, চরকিং, চরঈশ্বর, তমরুদ্দিন, চরচেঙ্গা, বুড়িরচর, জাহাজমারা ও নিঝুমদ্বীপসহ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের ঘরেও দেখা গেছে সোলার প্যানেল।

একই চিত্র দেখা গেছে কক্সবাজারের মহেশখালীতেও। এ দ্বীপের বিভিন্ন সড়ক মোড়ে শোভা পাচ্ছে সৌরবাতি। রাতের বেলায় বাজার জমজমাট। মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সোলার প্যানেলের মাধ্যমে দ্বীপবাসী এখন মোবাইলে চার্জও দিতে পারছে। চলছে টেলিভিশন ও ফ্রিজ।’

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি জনপ্রিয় করার নেপথ্যে থাকা অন্যতম ব্যক্তি দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া। ব্রাইট গ্রিন এনার্জি ফাউন্ডেশন বা বিজিইএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান দীপাল বড়ুয়া বর্তমানে বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশন বা বিএসআরইএ-র সভাপতি। এ ছাড়া সম্প্রতি তিনি ‘গ্লোবাল হান্ড্রেড পারসেন্ট রিনিউয়েবল এনার্জি'র অ্যাম্বাসেডরও নিযুক্ত হয়েছেন।

দীপাল চন্দ্র বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সৌরবিদ্যুতের দাম দিন দিন কমছে। সরকার গণমানুষের মাঝে এটি বিক্রির অনুমতি দেওয়ায় এর সুফল এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছে।’

দীপাল চন্দ্র বড়ুয়া আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ৫৫ লাখেরও বেশি সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। সেই হিসাবে এটি বিশ্বের বৃহত্তম সোলার প্রোগ্রাম। এরমধ্যে গ্রামীণ অঞ্চলে দুই লাখের বেশি সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপন করা হয়েছে। আরও ১০ লাখ সোলার স্ট্রিট লাইট স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়াও প্রায় ২ হাজার ১০০টি সৌর সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের দুর্গম চর, উপকূলীয় ও পার্বত্য এলাকায় সোলার হোম সিস্টেমের সঙ্গে সৌর সেচ পাম্প, সৌর মিনি-গ্রিড, সোলার আর্সেনিক ট্রিটমেন্ট প্রকল্প, সোলার স্ট্রিট লাইট, বিভিন্ন বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করা হয়েছে। এই নবায়নযোগ্য শক্তির কারণে কমেছে ফসিল তেল তথা কেরোসিনের ব্যবহার। কমেছে জ্বালানি কাঠের ব্যবহারও।’