মেহমানখানায় দেখা হবে এক বছর পরে

পুরো রোজার মাস জুড়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার লোক মেহমানখানায় ইফতার করেছেন বিনামূল্যে। বিকাল হলেই লালমাটিয়ায় রাস্তার দেখা গেছে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। স্কুল কলেজ বন্ধ। তরুণরা ঘরে বসে ক্লান্ত। যখন অভিভাবকরা কীভাবে তাদের সক্রিয় রাখবেন সেই চিন্তায় পড়েছেন, তখন একঝাক তরুণ স্বেচ্ছাসেবক হয়ে উঠেছেন। একমাসজুড়ে তারা রাস্তার ক্লান্ত রিকশাচালক, এলাকার এতিম, সিকিউরিটি গার্ড, নির্মাণ শ্রমিকের  খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা অসামান্য  এই কাজ করেছেন। আর দুই দিনে বন্ধ হবে মেহমানখানা। একবছর পর নিম্ন আয়ের মানুষের আবার দেখা যাবে মেহমানখানায়।

ইফতারের ঠিক আগে লালমাটিয়া, ৪/৮ ব্লক-ডি’র সামনের রাস্তায় গিয়ে দেখা যায়, একদিকে ইফতার সাজানো আছে, আর রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষা করছেন  মেহমানরা। কোনোধরনের হৈ চৈ নেই,  হুড়োহুড়ি নেই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অপেক্ষা। সন্ধ্যার আজানের আগ দিয়ে আশেপাশের বাসার সিকিউরিট গার্ড দৌড়ে এসে নিজের ভাগেরটা নিয়ে যান। আর পুরো আয়োজন যত্ন নিয়ে সম্পাদন করছেন কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ।

মেহমানখানার স্বেচ্ছাসেবকরাআয়োজকরা জানান, গতবছর শুরু হয়েছিল মেহমানখানা। তখন আয়োজন এত বড় ছিল না। এ বছর আয়োজন বড় হওয়ায় স্বেচ্ছাসেবক বাড়িয়ে ২০-২৫ করা হয়েছে। মেহমেনখানার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য যা অনেকের থেকে তাদের আলাদা করেছে, তা হলো প্রচারবিমুখতা। তারা যে আসলেই ভালোবেসে কাজটা করছেন, তা মেহমানদের প্রতি তাদের আচরণে প্রকাশ পায়।

বেসরকারি একটি সংস্থার কর্মী সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন ফেসবুকে পরিচিত মুখ। তার কয়েকটি পোস্ট গণমাধ্যমের নজরে আসে। তবে কীভাবে কার উদ্যোগে কাজ শুরু হলো তা নিয়ে কেউ আলাদা ক্রেডিট নিতে চাননি। থিয়েটারকর্মী আসমা আক্তার লিজা, তাঁর স্বামী জ্যোতির সঙ্গে আরও অনেকজনের ইচ্ছেপূরণের গল্প হয়ে উঠেছে মেহমানখানা।

মেহমানখানার খাবারগতবছর দীর্ঘ সাধারণ ছুটিতে নিম্ন আয়ের মানুষ পড়েছিলেন বিপদে। শিশুরা লালমাটিয়া এলাকার ভিতর ফুটপাতে চিৎকার করতো খাবারের জন্য। অসহায় শিশুদের জন্য নিজে রান্না করার মধ্য দিয়ে কখন কাজটি শুরু হয়ে যায় টের পাননি লিজা-জ্যোতি দম্পতি। এরপর আত্মীয়-স্বজনের সহায়তায় প্রথমে একশ’-দুশ’ করে হাজার মানুষের মেহমানদারি শুরু। তবে রমজানের পরও গতবছর প্রায় ৪ মাস ধরে প্রতিদিন একবেলা করে হাজার মানুষের মুখে খাবার তুলে দেন তারা।

কী দেওয়া হলো এক রিকশাচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি টানা কয়দিন এখানেই ইফতার করেছি। থাকে শরবত, জিলাপি, খেজুর, পেঁয়াজু, শসা ও মুড়ি, তরমুজ। পরিমাণে অনেক। এখানে এসে ইফতার করার কারণে কয়েক জনের মধ্যে শখ্যতা গড়ে উঠেছে বেশ।’ পাশ থেকে আরেকজন বলেন, ‘অনেকদিন পর পেট ভরে গরুর মাংস, খিচুড়ি খেয়েছি।’ প্রতিদিন হাজারেরও বেশি মেহমান এখানে ইফতার করছেন।

মেহমানখানার খাবারএরই মধ্যে রুকমান নামে এক রিকশাচালক আরেক রিকশাচালকের কাছে বিদায় নিলেন ঈদে বাড়ি যাবেন বলে। এ বছর আর মেহমানখানায় দেখা হবে না বলতে পাল্টা জবাব পেলেন, পর বছর হবে। অদ্ভুত বিষয় হলো যার যার প্লেট রেখে যান ফুটপাতের কোল ধেঁসে। সেসব তুলে আনতে কিছু সময় পার হয়ে যায় কিন্তু কোনোদিন কোনও প্লেটগ্লাস হারায়নি। সবাই জানেন এখন এটা মেহমানখানার জিনিস।

এবারের রোজায় প্রতিদিন দেড় হাজারের বেশি মানুষ ইফতার করেছেন মেহমানখানায়। আয়োজকদের একজন সৈয়দ সাইফুল আলম শোভনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কত জায়গা থেকে কত মানুষ যে যুক্ত হয়েছে আমাদের সঙ্গে। এটা হয়তো শুরু হয়েছে আমাদের মাধ্যমে, কিন্তু এককভাবে কারোর নাম বলার তেমন ইচ্ছে আমাদের নেই। আমরা রান্না করছি, খাওয়ানের জন্য আমরা সবাই মিলে হাত লাগাচ্ছি। শরবত বানায় যে রাতুল সে চট্টগ্রাম থেকে এসে যুক্ত হয়েছে। কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন এক শিক্ষক, আছে এলাকার শিশুরাও। স্বেচ্ছাসেবকরাই মেহমানখানার প্রাণ।’