সাত বছর আগে হাজার হাজার মন আম ধ্বংস করা হয়েছিল ফরমালিনের নামে। অথচ গবেষণায় জানা গেল শুধু আম নয়, ফলমূল শাক সবজিতেও ফরমালিনের কোন ক্ষতিকর ভূমিকা নেই। যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হতো সেটাও কার্যকর ছিল না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন –সেটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিন বছর আগে যখন আবার ইথোফেনের নামে আম ধ্বংস করা শুরু হল তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন- ইথোফেন অথবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম নিরাপদ। তখন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এখন আবার কার্বাইড কিংবা ফরমালিন দিয়ে পাকানোর অভিযোগে ধ্বংস করা হচ্ছে আম। ফলে জনমনে তৈরি হয়েছে দ্বিধা। প্রশ্ন তাদের- এসব রাসায়নিক মেশানো ফল কি ক্ষতিকর, নাকি নিরাপদ।
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এরপর ফরমালিন বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়- ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার,যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনও ভূমিকা নেই। উপরন্তু,প্রকৃতিগতভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে,যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়।
২০১৮ সালে আবারও আমে ইথোফেনের উপস্থিতি পায় অভিযান পরিচালনাকারীরা। ইথোফেন ক্ষতিকারক উল্লেখ করে ধ্বংস করা হয় শত শত মন আম । তখন ইথোফেন নিয়ে বিভ্রান্তি দুর করতে বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশ করা হয় ‘আমে ইথোফেন নিয়ে বিভ্রান্তি’ প্রতিবেদন। তার কিছুদিন পর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জানান,আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলছি, ইথোফেন-কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম ক্ষতিকর নয়। অপরিপক্ব আম পাকানো হলে তাতে পুষ্টির মাত্রা কম হতে পারে। কিন্তু সে আম ক্ষতিকর নয়। তাই দেশের সম্পদ ধ্বংস করা ঠিক নয়। ধ্বংসের আগে তা পরীক্ষা করা দরকার।
পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে কয়েক হাজার মণ আম ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে বৈজ্ঞানিক দিকগুলো সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরির জন্য আয়োজিত কর্মশালায় তিনি এসব কথা বলেন। ওই কর্মশালায় র্যাব অথবা পুলিশের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। সমালোচনার মুখে তখন অভিযান বন্ধ হলেও সম্প্রতি আবারও আমে রাসায়নিক প্রয়োগের অপরাধে ধ্বংস করা হচ্ছে আম। ইথোফেন কিংবা কার্বাইড পরিমাপের কোন যন্ত্র না থাকলেও শুধুমাত্র অপরিপক্ক আম বাজারে আসার কারণে ধ্বংস করা হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে রাসায়নিক কিংবা ফরমালিন ব্যবহার করার কারণে বিনষ্ট করা হচ্ছে।
গত ১ মে কুমিল্লার নিমসার বাজারে অভিযান চালিয়ে ‘ফরমালিন যুক্ত’ এক টন আম ধ্বংস করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আমগুলো পাইকাররা বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করেছিল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাবিনা ইয়াসমিন জানান,পরীক্ষা করে দেখা গেছে অপরিপক্ক আমগুলো ফরমালিন ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করে পাকানো হচ্ছিল। অভিযানে বেশ কয়েকটি আড়তে রাসায়নিক মিশ্রিত আমের মজুত পাওয়া যায়। সে কারণেই সেগুলো প্রকাশ্যে ধ্বংস করা হয়।
আমে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মোরশেদ আহমেদের কাছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,আম উৎপাদনকারীদের কৃষি বিভাগ একটি স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে গেছে। প্রত্যেক জেলায় আম পারার বিষয়ে তারিখ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। এখন দেখা যায় হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড় হলো তাতে কিছু আম পড়ে গেছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই আমগুলো নিয়ে বদ্ধ ঘরের ভেতরে রাখে, তাপ দিয়ে নরম করে, এবং হয়তো ইথোফেন দিয়ে কালার করে। এভাবে সেগুলোকে পাকা হিসাবে বিক্রি করে। এটা রীতিমতো অপরাধ। এই অপরাধ বন্ধ করার জন্য র্যাব পুলিশ যে ভূমিকা রাখার কথা, সেটা পালন করছে।
তিনি বলেন,এসব আম কাটার পর দেখা যায় আটি কাঁচা, শক্ত হয়নি। তখন পরিষ্কার বুঝা যায়- প্রতারণা করা হয়েছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
তবে তিনি বলেন,আমরা বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছি। আমচাষীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। দেখেছি কৃষকরা এখন আম উৎপাদনে ক্ষতিকর কিছু ব্যবহার করে না। মূলত কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী তারা সার আর কীটনাশক দেয়। এখন ইচ্ছাকৃতভাবে যারা অসময়ে অপরিপক্ক ফল নিয়ে আসছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া দরকার।
আম বা অন্য ফলে কার্বাইড ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি বলেন,কার্বাইড আইনে করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটা যদি একজায়গায় রেখে বাতাসে ছড়ানোর মাধ্যমে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেভাবে ক্ষতি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে ভুল প্র্যাকটিস করে। কার্বাইড পানিতে মিশায়ে ব্যবহার করা হয়, যার কারণে গায়ে লেগে থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া ইথোফেনের প্রয়োগ বিশ্বজুড়েই আছে। এটা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলে তা কখনই ফলের ভিতরে যায় না। এটা উদ্বায়ী, তাই বাতাসের সঙ্গে মিশে উড়ে যায়। এতে কোন ক্ষতি হয় না। তবে আমের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি খোঁজ নিয়েছি বিভিন্ন জায়গায়, এটা আমে ব্যবহার করা হয় না বললেই চলে।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আব্দুল কাইয়ুম বলেন,যেকোনো ফলমূল পাকানোর জন্য হরমোনকে একটা সিগন্যাল দিতে হয়। গাছে যখন নিজের পরিপক্কতা আসে তখন প্রাকৃতিক ভাবেই গাছ সিগন্যাল পায়, তখন ইথিলিন উৎপন্ন শুরু হয়। ইথিলিন যখনই উৎপন্ন হয় তখন ফলগুলো পাকবে। এখন যখন কোন গাছে ইথিলিন উৎপন্ন করার জন্য কৃত্রিমভাবে ইথফেন কিংবা কার্বাইড দেওয়া হয় তখন ফলটা পাকে। এখানে সেই রাসায়নিকের কাজ হল শুধু সংকেত প্রদান করা ফলে যাতে হরমোন উৎপন্ন হয়। সে কিন্তু নিজে আমকে পাকায় না। ইথোফেন-কার্বাইড সবই উদ্বায়ী,বাতাসের সঙ্গে মিশে যায় আমের ভিতরে প্রবেশ করে না।
তিনি আরও বলেন,আমাদের দেশে পিওর কার্বাইডের অনেক দাম। তাই অনেকে নন পিওর কার্বাইড ব্যবহার করে। যার মধ্যে হেভি মেটালের মিশ্রণ থাকে। যদি সেটা দেওয়া হয় তাহলে ওই আমের ভিতরে কিংবা খোসায় থেকে যেতে পারে। এই কারণে কার্বাইড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাধারনভাবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ফল পাকাতে এসব রাসায়নিকে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু যেভাবে ব্যবহার করার কথা সেভাবে না করে অন্য উপায়ে করছে, যার কারণে ঝুঁকি থেকে যায়।
কার্বাইড পরীক্ষা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন,আসলে এটা পরীক্ষা করে বের করার সুযোগ নেই কারণ এটার অস্তিত্ব থাকেই না। এজন্য বলা হয় যে, সঠিক উপায়ে রাসায়নিক দিয়ে পাকানো ফল স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর না।