বেসরকারি খাতেও টিকা আমদানির অনুমতি দেওয়ার সুপারিশ টিআইবির

ক্রয়বিধি অনুসরণ করে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দেওয়াসহ ১৯ দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সেই সঙ্গে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানিগুলোকে নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে টিকা উৎপাদনের সুযোগ প্রদান করারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

মঙ্গলবার (৮ জুন) প্রকাশিত ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলা: কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত এমন ১১টি সুপারিশ পেশ করা হয়। এ ছাড়াও অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কিত ৮টি সুপারিশ জানানো হয়।

পরে এ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন বিষয়ে কথা বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মনজুর-ই-আলমের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে আরো যুক্ত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশে কৌশলগত ঘাটতি থাকায় এবং ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর প্রভাব ও রাজনৈতিক বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে একক উৎসের ওপর নির্ভর করায় চলমান টিকা কার্যক্রমে আকস্মিক স্থবিরতা নেমে এসেছে।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে টিকা সম্পর্কিত যেসব সুপারিশ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- দেশের ৮০ শতাংশ জনসংখ্যাকে কীভাবে, কত সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় আনা হবে তার সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা; রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ব্যতীত টিকা ক্রয় চুক্তি সম্পর্কিত সকল তথ্য সকলের জন্য উন্মুক্ত করা; টিকা কেন্দ্রে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং অভিযোগের ভিত্তিতে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

অন্যান্য কার্যক্রম সম্পর্কিত সুপারিশের মধ্যে বলা হয়েছে- কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে তদন্ত ও সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা; স্টোরে ফেলে রাখা আইসিইউ, ভেন্টিলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি অতি দ্রুততার সাথে ব্যবহারযোগ্য করা; সকল জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন করা; কোভিড-১৯ চিকিৎসার খরচ সর্বসাধারণের আয়ত্তের মধ্যে রাখতে চিকিৎসা ফির সীমা নির্ধারণ করা; এবং স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর বিকল্প জীবন-জীবিকার সংস্থান করে সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় এলাকাভিত্তিক ‘লকডাউন’ দেওয়া এবং সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যাসহ নিষেধাজ্ঞার আওতা নির্ধারণ করা প্রভৃতি।

টিকা সংগ্রহ এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা, সমন্বয়হীনতা ও ক্রয় চুক্তিতে স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদ্যমান দাবি করে গবেষণার বরাত দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাপে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি উৎস ছাড়া বিকল্প উৎস অনুসন্ধানে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। জাতীয় কমিটি এবং বিএমআরসি একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের টিকা ট্রায়ালের অনুমোদন দিলেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ সাড়া না দেওয়ায় ট্রায়াল প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত টিকা ট্রায়ালের অনুমোদনেও দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশ সরকার, বেক্সিমকো এবং সেরাম ইনস্টিটিউটের মধ্যেকার টিকা ক্রয় চুক্তি প্রক্রিয়ায় ‘স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল প্রকট’ দাবি করে টিআইবি বলছে, টিকা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয়বিধি অনুসরণ করা হয়নি। যৌক্তিক কারণ না দেখিয়ে টিকা আমদানিতে তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশ (২ দশমিক ১৯ ডলার), ভারত (২ দশমিক ৮ ডলার), আফ্রিকান ইউনিয়ন (৩ ডলার) ও নেপালের (৪ ডলার) চেয়ে বেশি মূল্যে কোভিশিল্ড টিকা ক্রয় (৫ ডলার) করা হয়েছে। সরকার সরাসরি সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে টিকা আনলে প্রতি ডোজে যে টাকা বাঁচতো তা দিয়ে ৬৮ লাখ বেশি টিকা ক্রয়ের চুক্তি করা যেত। ক্রয় বিধি ২০০৮, এর ৩৮ (৪) (গ) অনুসরণ না করে ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সকল পক্ষকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে গেল দেড় বছর স্বাস্থ্য খাতে যে ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ছিলো, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে, জনবল নিয়োগে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, উপযোগিতা নিশ্চিত না করে হাসপাতাল সাময়িকভাবে প্রস্তুত এবং তা বন্ধ করার ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত ছিলো। তথ্য নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা আরও ঘনিভূত হয়েছে। সরকার দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে যতখানি তৎপর তার চেয়ে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ নিয়ন্ত্রণে শতগুণে বেশি তৎপর ছিলো। যা আত্মঘাতী বিষয়, এ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।