বিএডিসিতে অনিয়ম পর্ব-৪

অসময়ে বীজ বিক্রি, লোকসান ২৪ কোটি টাকা

নানা অনিয়মে চলছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের চতুর্থ পর্ব থাকছে আজ

নির্ধারিত মৌসুমে বিক্রি না করে পরে দাম কম ধরে বীজ বিক্রির ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনে (বিএডিসি)। এতে প্রায় ২৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আরও জানা গেছে, এভাবে বীজ বিক্রি করে টাকা হাতানোর সঙ্গে জড়িত আছে একটি চক্র। বিএডিসির আওতাধীন ৯টি প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হবিগঞ্জের ইটাখোলা বিএডিসি’র বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে ২০১৮-১৯ বিতরণ বর্ষে ২ লাখ ১৪ হাজার ৯৩১ কেজি মানঘোষিত বোরো (ব্রিধান-২৮) বীজ-ধান প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এর মধ্যে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯৬ কেজি বিএডিসি নির্ধারিত ৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। বাকি ১ লাখ ১৩৫ কেজি বীজ ২৪ টাকা দরে বিক্রি করা হয় বলে দেখানো হয়েছে। নির্ধারিত মৌসুমে বীজ ধানগুলো বিক্রি না করায় ওই কার্যালয়ের ক্ষতি হয়েছে ২৬ লাখ টাকারও বেশি।

একইভাবে ২০১৮-১৯ বর্ষে মানঘোষিত বোরো (ব্রিধান-২৯) ও প্রত্যায়িত আমন (বিআর-২২) বীজ কম দামে বিক্রি করায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয় ৫৫ লাখ টাকারও বেশি।

২০১৮-১৯ বর্ষে সিলেট কার্যালয়ে বিভিন্ন বীজ-ধান ডিলারদের মাধ্যমে ও সরাসরি বিক্রি করা হয়। ‘অসময়ে’ পুনঃদর নির্ধারণ করে বিক্রি করায় ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

ঝিনাইদহের দত্তনগর মথুরা বীজ উৎপাদন খামার থেকে ২০১৮-১৯ সালে ৮ হাজার ১৯৭ কেজি আমন (অবীজ) ধান উৎপাদন করা হয়। ওই বছর অবীজ আমন ১২ দশমিক ৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। কিন্তু ৮ হাজার ১৯৭ কেজি আমন অবীজ ধান ২০১৮-১৯ সালে বিক্রি না করে পরের বছর দাম কমিয়ে প্রতি কেজি সাত টাকা করে বিক্রি করা হয়।

একই কার্যালয় থেকে ওই অর্থবছরে ১৪ হাজার ৮৫০ কেজি বোরো অবীজ ধান উৎপাদন করা হয়। যা প্রতিকেজি ২৯ দশমিক ১৬ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। কিন্তু বোরো ধানগুলো ২০১৮-১৯ সালে বিক্রি না করে পরের বছর মাত্র আট টাকা দরে বিক্রি করা হয়। এতে ক্ষতি হয় প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বিএডিসির নানা রকম বীজের প্রদর্শনী। ছবি: বিএডিসির ওয়েবসাইট

দিনাজপুরের সুইহারী বিএডিসির উপ-পরিচালকের (বীজ বিপণন) অধীনে ২০১৭-১৯ সালে ও রংপুর বিএডিসি’র উপ-পরিচালক (বীজ বিপণন)-এর ২০১৮-১৯ সালে বিভিন্ন বীজ বিক্রি না হওয়ায় পরে দাম কমিয়ে বিক্রি করায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা।

বিএডিসির বগুড়া কার্যালয়ে ২০১৭-১৮ সালে ও পাবনা কার্যালয়ে ২০১৮-১৯ বিতরণবর্ষে পুনঃনির্ধারণকৃত দরে ৯০৭ দশমিক ৩৪২ মেট্রিক টন বোরো ধান বীজ বিক্রি করায় ক্ষতি হয় প্রায় ২ কোটি ১২ লাখ টাকা।

বগুড়া ও পাবনার উপ-পরিচালকের (বীজ বিপণন) অধীনে ২০১৭-১৯ সালে পুনঃনির্ধারণ করা মূল্যে ৮৯১ দশমিক ৮৯৭ মেট্রিক টন গম বীজ বিক্রিতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকারও বেশি। একই সময়ে ৩২৭ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন ডাল ও তেল বীজ বিক্রিতে ক্ষতি হয় প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ টাকা।

রাজশাহীর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ডাল ও তেল বীজ)-এর অধীনে ২০১৮-১৯ সালে ডাল ও তেল বীজকে মৌসুমে বিক্রি না করতে পারায় ক্ষতি হয় প্রায় ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

বিএডিসির একটি বীজ সংরক্ষণাগার

টাঙ্গাইলের মধ্যপুর বিএডিসি যুগ্ম পরিচালকের (বীপ্রকে) কার্যালয়ে ৩৬২ মেট্রেক টন বীজ সংগ্রহ মূল্য অপেক্ষায় কম দামে বিক্রি করা হয়েছে। এতে সংস্থাটির ৬৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।

বিএডিসির অধীনে থাকা কার্যালয়গুলোর প্রধানরা জানিয়েছেন প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এ কাজগুলো করা হয়েছে। এ অবস্থায় দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএডিসিকে সুপারিশ করা হয়েছে।

গুদামে ফেলে রাখায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি
হবিগঞ্জের ইটাখোলা বীজ উৎপাদন খামারে ২০১৮-১৯ উৎপাদন বর্ষে উৎপাদিত ৪০ মেট্রিক টন বোরো ধান বীজ খামারের বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রে গৃহীত না হওয়ায় গুদামে পড়ে ছিল। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এতে জড়িতদের দায় নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিএডিসির একটি বীজ সংরক্ষণাগার

স্থানীয় খামারের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে সদর দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা না পাওয়ায় বীজগুলো বিক্রি করা যাচ্ছে না। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জানতে চাইলে বিএডিসি’র চেয়ারম্যান ড. অমিতাভ সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ নিয়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছি। জড়িতদের কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে। দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আগের পর্বগুলো পড়ুন-
প্রথম পর্ব: কোটি টাকার সবজি বীজ গেলো কোথায়!
দ্বিতীয় পর্ব: ফসল উৎপাদনে কোটি টাকার লোকসান খোদ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনেই!
তৃতীয় পর্ব: ভুয়া বিল-ভাউচারের অর্থ আত্মসাৎ বিএডিসিতে