জনতা ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি পর্ব-৫

মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে বিবিএলসি, রফতানি হবে না জেনেও ঋণ!

ব্যাংকিং খ্যাতের নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ ও অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। রফতানির সামর্থ নেই জেনেও কোনও প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে মোটা অঙ্কের ঋণ। ব্যাংকটির আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন-এর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চশ ও শেষ পর্ব।

অস্বচ্ছল গ্রাহক ও জামানতবিহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি গুনছে জনতা ব্যাংক। মেসার্স নাসা স্পিনার্স লিমিটেডের নামে কুমিল্লা ইপিজেডের একটি প্রকল্পে ইস্যু করা ১৬৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেও টাকা আদায় করা যায়নি। মঞ্জুরিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রকল্পের জমিটাও ছিল ইজারায় পাওয়া। তাই ওটাও জামানত হিসেবে নেওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত গ্যারান্টির বিপরীতে বিপুল অংকের ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ গুরুতর অনিয়ম। জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ব্যর্থতাই এর জন্য দায়ী।

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে পৌঁছা একাধিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালনা পর্ষদের ২০০৮ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ৭০ কোটি টাকা দায় পরিশোধ করে জনতা ব্যাংক লোকাল অফিসে ৭০ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ তৈরি করা হয়। কার্যকরী মূলধন বাবদ ১৫ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়।

পর্ষদে উপস্থাপিত স্মারকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি টাকার বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৫ কোটি টাকা।

নথিপত্রে বলা হয়েছে, মঞ্জুরিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রকল্পের জমিও মর্টগেজ হিসাবে রাখা যায়নি। এতে ঋণটি হয়ে পড়েছে জামানতবিহীন।

আরও দেখা গেছে, ঋণের কিস্তি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ২০১১ সালে ঋণের দায় ১ম কিস্তি ২০১২ সালের মার্চ থেকে পরিশোধযোগ্য ধরে মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্ধারণ করে পুনঃতফসিল করা হয়। সে অনুযায়ীও কিস্তি আদায় হয়নি। পরে ঋণ হিসাবটি ক্ষতিজনক শ্রেণিকৃত হয়।

জামানতবিহীন হওয়ায় এ ঋণের পুরোটাই ব্যাংকের ক্ষতি। গ্রাহক তার ঋণ হিসাবে ২০১৩ সালের মার্চের পর কোনও টাকাও জমা করেনি। কিন্তু এরপরও ২০১২ সালের ডিসেম্বর হতে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ঋণ হিসাবে অনিয়মিতভাবে ৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা সুদ হিসাবে দেখানো হয়েছে। যা ব্যাংকিং গুরুতর অনিয়ম।

জনতা ব্যাংক বলেছে, পর্ষদে প্রস্তাব অনুমোদনের পর গ্রাহককে ঋণ বিতরণ করা হয়। প্রকল্পটি কুমিল্লা ইপিজেড-এ প্রতিষ্ঠিত এবং ওই জমি ইপিজেড নাসা স্পিনার্স লিমিটেডকে ইজারা দেয়। লিজপ্রাপ্ত জমি ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে নেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে নাসা স্পিনার্স লিমিটেডের কাছ থেকে করপোরেট গ্যারান্টি নেওয়া হয়। ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালকদের গ্যারান্টি ও ব্যক্তিগত গ্যারান্টিও নেওয়া হয়েছিল।

জনতা ব্যাংকের এমন জবাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে গ্রাহকের সক্ষমতা বিবেচনা না করেই জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া হয়েছে।

অস্বচ্ছল গ্রাহককেও জামানতবিহীন ঋণ
মেয়াদোত্তীর্ণ ও সন্দেহজনক দায় ছিল। রফতানি যে হবে না সেটাও ছিল পরিষ্কার। তারপরও ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র (বিবিএলসি) স্থাপন করে তামান্না সোয়েটার লিমিটেডকে ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এতে ব্যাংকের ক্ষতি হয়েছে ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকারও বেশি।

বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স তামান্না সোয়েটর লিমিটেডের ঋণ সংক্রান্ত নথিপত্র অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, গ্রাহকের অনুকূলে পর্ষদের ২০১২ সালে শ্রেণিকৃত এলটিআর (এফসি) খাতের প্রায় ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ৩য় বার এবং ডিমান্ড লোন (বিবিএলসি) খাতের প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা ২য় বার পুনঃতফসিল করা হয়।

নিরীক্ষায় দেখা যায় যে, বিবিএলসি খোলার তারিখে গ্রাহকের হিসাবে মেয়াদোত্তীর্ণ দায় ছিল। এরপরও নতুন ঋণ দেওয়া ছিল গুরুতর আর্থিক অনিয়ম। আবার কোনও ক্ষেত্রে পণ্য জাহাজীকরণের তারিখ পার হওয়ার পরও বিবিএলসি স্থাপন করা হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রে জাহাজীকরণের তারিখের ৪-৫ দিন আগেই বিবিএলসি স্থাপন করা হয়।

রফতানি হবে না জেনেও বিবিএলসি স্থাপন করে ইচ্ছাকৃতভাবে গ্রাহককে ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে এতে।

২০১৫ সালের ২০ এপ্রিলের ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, কারখানাটি বন্ধ। জামানতও কম। তাই বলা যায় প্রায় ১০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে ব্যাংকটির।

শর্ত ভেঙে ঋণ, ক্ষতি ১৫৫১ কোটি টাকা!
বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের সম্পাদিত সমঝোতা চুক্তি ভঙ্গ করে ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির ক্রয়কৃত রফতানি বিল (এফডিবিপি) অপ্রত্যাবাসিত থাকা সত্ত্বেও নতুন রফতানি বিল (এফডিবিপি) ক্রয় করা হয়েছে। এতে ব্যাংকটির প্রায় এক হাজার ৫৫১ কোটি টাকা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

নিরীক্ষায় ঢাকার ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ)-এর শর্ত পালন না করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এফডিবিপি অপ্রত্যাবাসিত থাকা সত্ত্বেও নতুন এফডিবিপি কেনায় ব্যাংকের বিপুল টাকা ঝুঁকিতে পড়েছে।

২০১৬ সালের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ৪ হাজার ৩১৮ কোটি ৯৮ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সম্পাদিত (এমওইউ)-এর ৪ নং অনুচ্ছেদ অনুয়ায়ী মূলধনের ভিত্তিতে একক বা গ্রুপ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ফান্ডেড ঋণসীমা ১০ শতাংশ (এক্ষেত্রে ৪৩ কোটি ১৯০ লাখ টাকা)। ২০১৭ সালে আলোচ্য গ্রাহক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের ফান্ডেড দায়ের পরিমাণ ছিল এক হাজর ৫৫১ কোটি ৬৪ লাখ টাকারও বেশি। এক্ষেত্রেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে জনতা ব্যাংকের সম্পাদিত চুক্তি মানা হয়নি।

আরও দেখা গেছে, ওই গ্রাহকের মেয়াদোত্তীর্ণ রফতানি বিল (এফডিবিপি) থাকা অবস্থাতেই নতুন করে রফতানি বিল (এফডিবিপি) ক্রয় করে গ্রাহকের দায় বাড়িয়ে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করা হয়েছে।

খেলাপির পথে আরও ৪৮৫ কোটি টাকা
ক্রয়কৃত রফতানি মূল্য (এডিবিপি) ম্যাচুরিটি তারিখের পর অপ্রত্যাবাসিত থাকা সত্ত্বেও নতুন রফতানি বিল ক্রয় (এডিবিপি) করায় জনতা ব্যাংকের ব্যাংকের প্রায় ৪৮৫ কোটি টাকা খেলাপির পথে রয়েছে। ব্যাংকটির রাজধানীর ইমামগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক রিমেক্স ফুটওয়্যারের কাছে ব্যাংক এ টাকা পাবে। কোম্পানিটির রফতানি বিল ক্রয় সংক্রান্ত রেজিস্ট্রার ও বিবরণী নথি পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এফডিবিপি অপ্রত্যাবাসিত থাকা সত্ত্বেও নতুন এফডিবিপি করা হয়েছে।

অনিয়মগুলোর বিষয়ে ২০১৮ সালের ২৮ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর অগ্রিম অনুচ্ছেদ জারি করা হয় এবং তাগিদপত্র দেয়া হয়। ২০১৯ সালে সচিব বরাবর আধাসরকারি পত্র দেওয়া হয়। তবে এখনও জবাব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুছ ছালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। ফোন রিসিভ করলেও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. এসএম মাহফুজুর রহমান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যখন কোনও ব্যাংকে অডিটে যায় তখন ওটাকে সামনে রেখে এক্সটার্নাল অডিট বা ইন্টার্নাল অডিট সব দেখে। এরপর বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেয়। অডিট অধিদফতরের কমেন্ট ঠিক আছে কিনা সেটাও দেখা হয়।’

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এর সঙ্গে বড় চক্র জড়িত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতাও রয়েছে বলে আমার ধারণা।’