তদবিরের চাপে সচিবালয়

সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পোস্টিং নিয়ে তদবিরের চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। সচিবালয়ের ভেতর ও বাইরে কর্মরত স্টাফরাও সচিবালয়ে আসছেন তদবির করতে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, এমনকি সচিবালয়ের প্রবেশদ্বারেও এখন ভিড় লক্ষ করা যায়। সপ্তাহে একদিন (সোমবার) সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও বিভিন্ন অজুহাতে এদিনও সচিবালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেন দর্শনার্থীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রীতিমতো বিরক্ত ও বিব্রত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মহামারি অনেকটা কেটে যাওয়ায় এ প্রবণতা বেড়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, বিশেষ করে জেলা-উপজেলা থেকে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয়ে আসেন বিভিন্ন প্রকার তদবির নিয়ে। সাধারণ মানুষ এলাকার রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, মাদ্রাসা নির্মাণ, অনুদান, চাকরিসহ নানা তদবিরে সচিবালয়ে এলেও সরকারি কর্মচারীরা আসেন তাদের পদোন্নতির জন্য। কেউ কেউ আসেন অপেক্ষাকৃত ভালো ও সুবিধাজনক স্থানে পোস্টিং পাওয়ার জন্য। এসব তদবিরের চাপ সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অনেকটাই হিমশিম খাচ্ছেন। এতে তারা অনেকটা বিব্রত বলেও জানিয়েছেন। 

জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন,  আমি তো বিশেষ কোনও জেলার লোক নই। সরকারের উচ্চপদে আমার কোনও আত্মীয়-স্বজনও নাই। তাই তদবির করতে পারছি না। ফলে এবারও আমার অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি হলো না। কবে হবে জানি না। তিনি জানান, সবাই হয়তো তদবির করেন না। তবে কেউ কেউ তো করেন। তারা করেন বলেই আমরা পেছনে পড়ে যাই—বিষয়টি এমন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন উপ-সচিব জানিয়েছেন, ডিসি ফিটলিস্টে নাম আছে। তারপরও পোস্টিং পাচ্ছি না। পদের তুলনায় প্রার্থী বেশি হওয়ায় তদবিরে কাজ দেয়। তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা তদবির করে পোস্টিং নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আমি পড়েই আছি। প্রশাসনে মাঠ পর্যায়ে ডিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ। তাই প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক।

পিরোজপুর জেলা প্রশাসকের দফতরে কর্মরত এক কর্মচারী সচিবালয়ে এসেছেন তার পছন্দের জেলায় পোস্টিং পাওয়ার জন্য। এ জন্য সচিবালয়ে কেন জানতে চাইলে তিনি জানান, মন্ত্রী-এমপি দিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে ফোন বা ডিও না দিলে কাজ হবে না। আমার নিজ এলাকার এমপি সরকারের একজন মন্ত্রী। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তাকে দিয়ে ফোন করাবো। তাই সচিবালয়ে এসেছি। দেখি পোস্টিংটা হয় নাকি?

শুধু তাই নয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত। কোনও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বা সচিবকে এ ধরনের চিঠি লেখেন তখন রীতিমতো তারা বিব্রত হন। কারণ, যারা অনুরোধ করছেন বা ডিও দিচ্ছেন তারা সিনিয়র। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয়তো এ ধরনের ডিও’র অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোবারক হোসেন সচিবালয়ে এসেছেন স্থানীয় কিছু উন্নয়নমূলক কাজের দরপত্র যেন তাড়াতাড়ি হয় তার তদবির করতে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে অবস্থানরত মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, ঢাকায় এসে তদবির করলে কাজটা দ্রুত হবে। মন্ত্রণালয়ের অনেক কাজ। তাই সরাসরি কাজটি করিয়ে নিতে স্থানীয় এমপির লিখিত চিঠি নিয়ে এসেছি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর কাছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি অনৈতিকও বটে। আর আইনে তো নিষেধ করাই আছে। এরপরও যারা করেন, তারা গুরুতর অন্যায় করেন। এটি ঠিক নয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠায়ও বিষয়টি বাধা সৃষ্টি করে।  

উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনও সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০ ধারায় বলা আছে, ‘কোনও সরকারি কর্মচারী তাহার চাকরি-সংক্রান্ত কোন দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোন সরকারি কর্মচারীর ওপর রাজনৈতিক বা অন্য কোনও বহিঃপ্রভাব খাটাইতে বা খাটাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না।’ আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনও সরকারি কর্মচারী কোনও ব্যাপারে তাহার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য সংসদ সদস্য বা অন্য কোনও বেসরকারি ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুরোধ জানাইতে পারিবেন না।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিবালয়ে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা রাজীব দাস বলেন, তদবিরকারীদের চাপে ডিউটি করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সোমবার দর্শনার্থীদের সচিবালয়ে প্রবেশাধিকার না থাকলেও নানাভাবে প্রবেশের চেষ্টা করেন। এতে আমরা বাড়তি চাপে পড়ি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জানান, সচিবালয়ে কি যে মধু আছে, তা আজও বুঝলাম না।