যাইহোক, বাংলাদেশে পুলিশদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অপেশাদার আচরণ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। এটা নিত্যই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে। ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা বিকাশ এবং সর্বশেষে গতকাল একজন এনজিও কর্মীকে নির্যাতনের ঘটনা মিডিয়ার নজরে পড়ে গেছে বলেই তা নিয়ে এখন এত আলোচনা-সমালোচনা। বলা দরকার যে, যেসব কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি এখনও অনুন্নত, সেইসব কারণেই বাংলাদেশের পুলিশদের আচরণও অনুন্নত। এসব কারণের মধ্যে শিক্ষা ও নৈতিকতার সংস্কৃতি পরোক্ষভাবে দায়ী থাকলেও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী আছে দলীয়করণ ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে পুলিশের অপব্যবহার। যে সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন পুলিশ হয়ে যায় সেই সরকারের, জনগণের নয়। যদি জনগণেরই হতো তাহলে জনগণকে নির্যাতন করে পুলিশ ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বলতে পারেতো না- ‘মাছের রাজা ইলিশ –দেশের রাজা পুলিশ’। পুলিশদের এই ঔদ্ধত্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সব সরকারের আমল থেকেই চলেই আসছে। বিএনপি আমলে একজন মানুষ হত্যা করেও এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলতে শোনা গেছে পুলিশ কোহিনুর মিয়াকে। পুলিশি হেফাজতে তরুণী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা, রুবেল হত্যা এর সবই আমাদের মনে আছে। পুরনো পত্রিকা ঘাটলে সরকারকে বড় ভাই ভেবে পুলিশের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অমাণবিক কথা ও আচরণের বহু ঘটনা মিলে যাবে। এমনকি ইউটিউব ঘাটলে বাংলাদেশ পুলিশের অমাণবিক ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিডিওচিত্র পাওয়া যায়।
পুলিশ মনে করে যে, যেহেতু তারা সরকারকে টিকিয়ে রাখছে, সেহেতু পুলিশকে যত্ন ও রক্ষা করার দায়িত্ব হলো সরকারের। আর সরকার যখন তা করতে যায় তখন আইনের শাসন ভুলুণ্ঠিত হয়। অর্থাৎ আইনের শাসনের অভাবে পুলিশের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। তাছাড়া, পুলিশরা যখন সরকারের পক্ষপাতিত্ব করে তখন তারা পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়। এদেশের রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষকে নির্যাতন করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি কমবেশি চলেই আসছে যা আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে জিইয়ে রাখছে। এই বিচারহীনতার সুযোগ নিচ্ছে অন্যদের মতো পুলিশরাও।
এরপর আসছে পেশাদারিত্বের অভাবের কথা। ইউরোপের একজন পুলিশের পেশাদারিত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন পুলিশের পেশাদারিত্বের তুলনা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। লন্ডনে প্রতি রাতে পুলিশ সদস্যরা রাস্তায় টহল দেন মানুষকে মানবিক সাহায্য দেওয়ার জন্য। একজন মাতালকে যদি বাড়ি যেতে অক্ষম অবস্থায় পাওয়া যায় তবে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বটা নেন টহলরত পুলিশ। বাসস্টপগুলোতে পুলিশরা ঘুরে বেড়ান সহযোগিতা প্রার্থী মানুষ পাওয়ার জন্য। যেমন- লন্ডনে রাত যত বাড়ে বাসের সংখ্যাও তত কমে। কোনও কোনও রুটে রাত বারোটার পরে আর বাস থাকে না। এমতাবস্থায় যদি এমন কোনও রুটের যাত্রীকে বাসস্টপে পাওয়া যায় তবে, ট্যাক্সি খুঁজে দিয়ে হোক বা পুলিশের গাড়িতে করে হোক ওই যাত্রীকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় পুলিশের ওপর। লন্ডনে বন্ধুর বাসা থেকে দেরি করে ফেরার কারণে বাস না পেয়ে পুলিশের গাড়িতে করে নিজ বাসায় ফেরার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আমি ভদ্রলোককে বলেছিলাম ট্যাক্সি খুঁজে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে তাদের গাড়িতে করে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমন পেশাদারিত্ব বাংলাদেশে কল্পনা করা যায় না। এর পেছনে যে শুধু পুলিশরাই দায়ী তা নয়, আমরাও দায়ী এ কারণে যে আমরা জানি না পুলিশের কাছ থেকে আমরা কোন সহযোগিতা কিভাবে পেতে পারি। ইউরোপে এই পেশাদারিত্ব শুধু পুলিশদের মধ্যেই নয়, ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক সর্বক্ষেত্রে। যুক্তরাজ্যের জনগণেরা জানেন, ৯৯৯-এ ফোন করলে ১ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে চাহিদামতো পুলিশ, নার্স বা ফায়ার সার্ভিস কর্মী পাওয়া যায়। ফোনে কথা বলার পর প্রথমেই কর্মকর্তারা জেনে নেন ঠিকানা, অতঃপর প্রার্থী সমস্যার কথা বলতে বলতে দেখতে পাবেন প্রত্যাশিত পুলিশ, নার্স বা ফায়ার সার্ভিস কর্মী সামনে হাজির। এমন সহজ দিন একদিন আমাদেরও আসবে। আবারো বলছি বিষয়টা উপরিকাঠামোর তাই সময় লাগবে।
বাংলাদেশে পুলিশদের দায়িত্বহীন ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের আরও কারণের মধ্যে পড়ে দুর্নীতি। ঘুষ দিয়ে শুধু চাকরি লাভই নয়, চাকরি লাভের পর কোথায় গেলে বেশি ঘুষ পাওয়া যাবে সেখানে যাওয়ার জন্য দেওয়া হয় আরও ঘুষ। এরপর জায়গামতো গিয়ে তারা যা করেন তা চাকরি বা দায়িত্ব নয়, চলতে থাকে আগে দেওয়া সব ঘুষ তুলে লাভের উপর লাভ তোলার লাগামহীন চর্চা।
এরপর আসছে প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটি। বাংলাদেশ পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিটা জ্ঞান, দক্ষতা, দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতা ও কর্তব্যবোধের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল রাজনীতি ও ক্ষমতার ওপর। আর তাই এদেশের পুলিশদেরকে মানবিকতা, নৈতিকতা, মানবাধিকার ও মৌলমানবাধিকার এ বিষয়গুলো চর্চা থেকে দূরে থাকতে দেখা যায়। আরও জোর দিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় এদেশের অনেক পুলিশ হয়তো জানেনই না মানবাধিকার ও মৌলমানবাধিকার এ বিষয় দুটি আসলে কী।
পুলিশের ঔদ্ধত্য, পক্ষপাতিত্ব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ঘটনা উপমহাদেশের পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, আফ্রিকার নাইজেরিয়া, ঘানা, জিম্বাবুয়ে প্রভৃতিসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই ঘটে আসছে। মাঝে মাঝে ইংল্যান্ড আমেরিকাতেও ঘটে। যদিও তা প্রায়শই বর্ণবাদী ঘটনার আওতায় পড়ে যায়। ২০ অক্টোবর ২০১৪, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ঘটনা, ১৭ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ লাকুয়ান ম্যাকডোনাল্ডকে শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ভ্যান ডাইক ১৬ বার গুলি করে হত্যা করেন। এর দুমাস আগে ৯ আগস্ট ২০১৪, সেদেশের মিসৌরিতে শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডারেন উইলসন গুলি করে হত্যা করে মাইকেল ব্রাউন নামের ১৮ বছরের কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে। ৪ আগস্ট ২০১১, লন্ডনে শেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক (২৯) মার্ক ডুগানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণাঙ্গদের ডাকা দাঙ্গায় সারা ইংল্যান্ডজুড়ে অচলাবস্থার কথা আমাদের সবার জানা।
ইংরেজি পুলিশ (POLICE) শব্দটি বিশ্লেষণ করে বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তন্মধ্যে জনপ্রিয়টি হলো- (Polite) ভদ্র, (Obedient) বাধ্যগত, (Loyal) দায়িত্বশীল, (Intelligent) বুদ্ধিমান, (Courageous) সাহসী, ও Efficient (দক্ষ)। বাংলাদেশের পুলিশদের মধ্যে এর সবগুলো গুণেরই অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বেশি অভাব প্রথমটির। দেরি করে হলেও পৃথিবীর সব পুলিশেরা একসময় দক্ষতা, দায়িত্বশীলতা, নৈতিকতা, কর্তব্যবোধ এবং মানবাধিকার ও মৌলমানবাধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা, বিশ্বাস করা এবং চর্চায় মন দেবে। আগামী কয়েকশ বছর পর পৃথিবীর মানুষেরা যখন অনেক কিছু জেনে যাবে, দেশগুলো তখন কাছাকাছি হয়ে যাবে। পৃথিবীজুড়ে উপরিকাঠামোর একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। সেই সময় পুলিশরা হবে সবার কাছে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয়।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী।
ইমেইল- sea.sky.rafi@gmail.com
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।