দুর্নীতি-অনিয়মের পাহাড়সম অভিযোগ মাথায় নিয়ে পরিষদ বসছে আজ

শিল্পকলা একাডেমির পরিষদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ—কোনও কিছুই তোয়াক্কা করছেন না শিল্পকলার মহাপরিচালক (ডিজি) লিয়াকত আলী লাকী। ইচ্ছেমতো বদলি, পরিষদকে না জানিয়ে অফিস আদেশ, অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে আশ্রয়-প্রশ্রয়; এমন বহু গুরুতর অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। একাডেমিতে প্রায় ২২৭ কোটি ৭১ লাখ টাকার অনিয়মের সন্ধানও পেয়েছে হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত অনুসন্ধান করে এই তথ্য পাওয়া যায়। এতে অনিয়মের ৭২টি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। একের পর এক অভিযোগের পাহাড় মাথায় নিয়েই আজ রবিবার (১৯ ডিসেম্বর) বসছে পরিষদের সভা।

কয়েকজন পরিষদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে আগের সভার পরামর্শ, সিদ্ধান্ত ও ফলোআপসহ বেশকিছু বিষয়ে আলাপ উঠতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিল্পকলার এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেসব রিপোর্টও জমা হয়েছে। আশা করা যায়, সেসবের সঠিক প্রয়োগ হবে। সভার আগে আর কোনও মন্তব্য করতে চাই না।

অগ্রিম সাড়ে ১৩ কোটি টাকা

সাম্প্রতিক অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়, শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্রিম বাবদ ১৩ কোটি ৫৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৬৬ টাকা দেওয়া হয়েছে। ড্যান্স অ্যাগেইনস্ট করোনার আওতায় খণ্ডনৃত্য কোরিওগ্রাফি অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে ৯৪ লাখ ৬ হাজার ২৪৪ টাকার চেক দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠানটি আর হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্মুক্ত দরপত্র বাদ দিয়ে বিধিবহির্ভূতভাবে খণ্ড খণ্ড ভাউচার ও আরএফকিউ’র মাধ্যমে মালামাল কিনে অনিয়মিত ব্যয় করা হয়েছে ৬৯ লাখ ৫১ হাজার ৪১৯ টাকা। উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির বিপরীতে বরাদ্দকৃত অনুদান ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ের সত্যতাও পায়নি অডিট দল।

ভুয়া ভাউচার যখন ‘কালচার’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিল্পকলা একাডেমিতে জিনিসপত্র কেনার নামে যেসব ভাউচার যুক্ত করা হয় সেগুলোর বেশিরভাগ দোকানের কোনও অস্তিত্ব নেই। একাডেমির নামে তানিয়া বেডিং-এর একটি ভাউচারে দেখা যায় পর্দা কেনা হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার টাকার। বিক্রেতার নাম লেখা হামিদ, দোকানের মালিক মাসুদ রানা। রানার নম্বরে কল করলে তিনি হামিদকে চেনেন না বলে জানান। চলতি বছর ২৭ জুন শিল্পকলা একাডেমিতে পর্দা বিক্রি করেছেন কিনা জানতে চাওয়া হলে সময় নেন মাসুদ। তারপর বলেন, তিনি কোনও পর্দা বিক্রি করেননি। তবে তার দোকান থেকে একটা স্লিপ নিয়ে গেছে একজন।

কেনাকাটার ভাউচারে যার স্বাক্ষর রয়েছে সেই কেয়ারটেকার (প্রশাসন) সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনের কাছে স্বীকার করেন, তারা বরাবরই ভাউচার ম্যানেজ করেন। তারপর ধীরে ধীরে কেনেন। তার এ বক্তব্য প্রকাশ পাওয়ার আট দিনের মাথায় তাকে চাঁদপুর বদলি করে দেওয়া হয়।

শেষ কর্মদিবসে ১৫ কোটি টাকার অনিয়ম

অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের শেষ কর্মদিবসে অগ্রিম প্রদান করায় ১৫ কোটি ২৯ লাখ ৯৫ হাজার ৬১৩ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। ক্যাশবুক যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি এবং ক্যাশবুকের জের ও ব্যাংক বিবরণী জেরের সঙ্গে ১৭ কোটি ৫১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২৯ টাকার গরমিল পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অনুদান খাতের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করে ২ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার ৪৫৫ টাকা রেখে দেওয়া হয়েছে। পিপিআর লঙ্ঘন করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে পণ্য ও মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাৎসরিক ক্রয়সীমা অতিক্রম করে অনিয়মিতভাবে অতিরিক্ত ২২ লাখ ৪ হাজার ২৪৮ টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

পরিষদের সদস্য কামাল বায়েজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সমষ্টিগত কোনও বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো না। ব্যক্তিগত মতামত হলো, আমি অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিটি প্রতিবেদন পড়েছি। সেগুলোতে অনিয়মগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আমি এই দিন সভায় প্রথমবারের মতো যোগ দিতে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থভূমি শিল্পকলা একাডেমি। সেই জায়গা থেকে তাদের যে দায়িত্ব তা তারা কতটুকু পালন করেছে তার ব্যাখ্যা চাওয়ার ইচ্ছে আছে। শিল্পকলা কোনও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের জায়গা নয়। তারা শিল্পী তৈরি করবেন। সে কাজ আদৌ কীভাবে হচ্ছে, বা অনিয়মের যে বিষয়গুলো উঠে আসছে সেগুলোর বিষয়ে জানা জরুরি।

পরিষদের সদস্য মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, এখনও এজেন্ডা হাতে পাইনি। তবে জরুরি বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯ অনুযায়ী, পরিষদ প্রতি তিন মাসে কমপক্ষে একবার সভায় মিলিত হবে এবং সভার তারিখ, সময় ও স্থান পরিষদের সভাপতি কর্তৃক নির্ধারণ করা হবে৷ একাডেমির সভাপতি প্রয়োজনবোধে, যে কোনও সময় পরিষদের বিশেষ সভা আহ্বান করতে পারবেন। পরিষদের শেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত এপ্রিলে।