চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় ডিভাইস সরবরাহকারীকে খুঁজছে গোয়েন্দারা

সরকারি কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস এবং পরীক্ষার্থীদের কাছে এসব বিশেষ ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস সরবরাহকারীকে শনাক্ত করতে পেরেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান গোয়েন্দা বিভাগ। ডিভাইস সরবরাহের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘এসব বিষয়ে তদন্ত চলছে’। প্রাথমিকভাবে চার জনের নাম পেয়েছেন তারা, তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম প্রকাশ করছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। ফাঁস হওয়া প্রতিটি প্রশ্ন বিক্রি করা হতো ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় আর লেনদেন হতো ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অভিযান পরিচালনা করে অচিরেই তাদের গ্রেফতার করা হবে বলেও জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পরীক্ষার্থীদের হাতে ডিজিটাল ডিভাইস পৌঁছে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকায় গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের অভিযানে শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) রাজধানীর মিরপুর, কাকরাইল ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ১০ জনকে। যেখানে বহিষ্কৃত এক সরকারি কর্মকর্তা এবং এক নারী ভাইস চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় তিন পরীক্ষার্থীকেও। মূলত এই চক্রের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বহিষ্কৃত ওই সরকারি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেফতারকৃত মাহমুদুল হাসান আজাদ প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজেই ডিভাইস সংগ্রহ করতেন, আর তিনি যাদের মাধ্যমে ডিভাইস সংগ্রহ করতো তাদের সম্পর্কে তদন্ত করা হচ্ছে।

ডিভাইসগুলো সংগ্রহ করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীদের হাতে এসব ডিভাইস পৌঁছে দিতো সে। বেশ কয়েকটি ভাগে চলছিল তাদের এই প্রশ্নফাঁস এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে অপতৎপরতা। গ্রেফতারকৃত নোমান সিদ্দিকী পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ এবং উত্তরপত্র সাপ্লাই করতো। তার ছিল একটি টিচার্স প্যানেল। অন্যদিকে বগুড়ার ধুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপা বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রার্থী সংগ্রহ করে টাকা পয়সায় বনিবনা হলে আজাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতো এবং পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিভাইস সরবরাহ করতো। এছাড়া গ্রেফতারকৃত নোমান সিদ্দিকী গ্রেফতারকৃত অন্যান্য আসামি আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান তাদের কাজ ছিল পরীক্ষার্থী সংগ্রহ করা।

প্রশ্নফাঁস

গোয়েন্দারা বলছেন, নোমান সিদ্দিকী ৬ থেকে ৭ বছর ধরে নিয়োগ পরীক্ষায় এ ধরনের জালিয়াতি সাথে জড়িত। ডিজিটাল ডিভাইস সাপ্লাই দিয়ে আসছিল পরীক্ষার্থীর কাছে। আর নোমানকে যে ব্যক্তি ডিভাইস সাপ্লাই দিয়েছে দিয়ে আসছিল তাকে শনাক্ত করা গেছে। ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। নোমান বিভিন্ন ধরনের কাস্টমাইজড হ্যান্ড ওয়াচ, ইয়ার ডিভাইস (কানের) পরীক্ষার্থীদের সাপ্লাই দিয়ে আসছে। বডি চেঞ্জের (একজনের পরিবর্তে অন্য অন্যজন পরীক্ষায় অংশ নেওয়া) কাজও করে আসছিল সে। তাদের এক্সপার্ট গ্রুপের সদস্যরা পরীক্ষার্থীর পরিবর্তে তারা অংশ নিয়ে পরীক্ষা দিতো, এডমিট কার্ডের ছবি পরিবর্তন করে। 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আরও বলছেন, বগুড়ার ধুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাসরিন মাহবুবা রুপা মূলত একজন দালাল এবং তদবিরবাজ। ঢাকা শহরে এসে বিভিন্ন মহিলা হোস্টেলে এসে অবস্থান নিতেন তিনি। সেই সঙ্গে নিজের জনপ্রতিনিধির পরিচয় ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় তদবিরের কাজ করে আসছিলেন। চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজেই ডিভাইসসহ পরীক্ষায় অংশ নেন। আর এটাই ছিল তার শেষ নিয়োগ পরীক্ষা (সরকারি চাকরির)। সে কারণে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আর এই ডিভাইসটি তিনি নোমানের কাছে থেকে সংগ্রহ করেছেন। রুপার সঙ্গে নোমানের যোগাযোগ অনেক পুরনো। আর তাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল রুপার ভাই রাকিব। 

ডিএমপির গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অপতৎপরতার অভিযোগে ১০ জনকে গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে আমরা আরও বেশ কয়েকজনের নাম পেয়েছি। তাদের শনাক্ত করে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। এই ডিজিটাল ডিভাইসগুলো কোথা থেকে এসেছে এবং কাদের মাধ্যমে এসেছে এসব বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখছি তদন্ত করে দেখছি। 

গুলশান গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোঃ কামরুজ্জামান সরদার বাংলা ট্রিবিউন কে বলেন, গ্রেফতারকৃত ১০ জনের মধ্যে বহিস্কৃত সরকারি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ ২০১৩ সালে, নাহিদ হাসান ২০১৬ সালে এবং আল আমিন সিদ্দিকী ২০১৯ সালে প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল। কারাভোগের পর তারা আবার একই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি প্রশ্নপত্র ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হতো। আর লেনদেন হতো বিভিন্ন ব্যাংক এবং বিকাশ ও নগদ এর মাধ্যমে।