হাফেজি বাদ দিয়ে ডাকাতি পেশায় ওরা

ছোটবেলায় তাকে বাড়ির পাশের মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। চেয়েছিলেন ছেলে কোরআনের হাফেজ হবে। ৩০ পারা কোরআন মুখস্থ করে ছেলে হাফেজও হয়েছিল। চাকরি নিয়েছিল স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়। কিন্তু বছর দুয়েক যেতে না যেতেই সেই চাকরি ছেড়ে চুরি-ডাকাতি শুরু করে। এখন সে আন্তজেলা ডাকাত দলের সর্দার। তার নাম লোকমান হাকিম ওরফে লিটন শেখ। রাজধানী ঢাকাসহ মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী ও ফরিদপুরে তার বিচরণ। ডাকাতি মামলায় একাধিকবার জেলও খেটেছে সে। সর্বশেষ রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতির সময় তিন সহযোগীসহ গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে লিটন শেখ। লোকমান ওরফে লিটন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় কৃষি ব্যাংকে ও সদরের বাইটকামারির একটি মন্দিরে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদাত হোসেন সুমা জানান, ডাকাত সরদার লোকমান হাকিম ওরফে লিটনসহ চার জনকে একদিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা পেশাদার ডাকাত। এই ডাকাত দলের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে একাধিক ডাকাতি মামলাসহ খুন ও অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগে মামলা রয়েছে।

গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে লোকমান হাকিম ওরফে লিটন জানায়, তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের উলপুর উত্তরপাড়ার নিজরা এলাকায়। বাবার নাম মৃত তাজেক শেখ। ছোটবেলায় স্থানীয় হাফেজিয়া শামসুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছিল। ১৯৯৯ সালে ওই মাদ্রাসা থেকে হেফজ সম্পন্ন করে। এরপর রাজপাট এলাকার এক মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়।

লোকমান হাকিমের ভাষ্য—রাজপাটের ওই মাদ্রাসায় বছর দুয়েক চাকরি করার পর হঠাৎ তার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। চাকরি থেকে ইস্তফা নিয়ে বাসাতেই থাকতো সে। মাদ্রাসায় পড়ার সময়ে ১৯৯৬ সালেই বিয়ে করে লিটন। কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় তার স্ত্রী মারা যায়। এরপর আর বিয়েও করেনি। মাথার সমস্যা কিছুটা ভালো হলে জীবিকা নির্বাহের জন্য ভ্যান চালানো শুরু করে। এরপর হঠাৎ করেই অসৎ সঙ্গে গিয়ে চুরি-ডাকাতি শুরু করে লোকমান ওরফে লিটন শেখ।

গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে লিটন শেখ জানায়, মাদ্রাসায় পড়ার সময়ে তার বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় একটি ডাকাতির মামলা হয়েছিল। মাদ্রাসার এক সিনিয়র শিক্ষার্থীর প্রেমিকাকে বাসা থেকে তুলে এনেছিল তারা কয়েকজন। ওই ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে ওই মেয়ের পরিবার ডাকাতি মামলা দিয়েছিল। ওই মামলায় প্রায় মাস তিনেক জেলও খাটে লিটন। পরে আপস হওয়ার কারণে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে সে।

লোকমান হাকিম ওরফে লিটন শেখ জানায়, তিন মাস কারাগারে থাকার সময় তার সঙ্গে কয়েকজন ডাকাতের পরিচয় হয়েছিল। সেই পরিচয়ের সূত্র, আর স্থানীয় ডাকাত সদস্যদের সঙ্গে পরিচয়ের পর পুরোদমে ডাকাতি পেশায় জড়িয়ে পড়ে সে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর উপ-শহর কেরানীগঞ্জে একটি ডাকাতির ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ডাকাত দলের সূত্র ধরে তারা লোকমান হাকিমের বিষয়ে তথ্য পান। পরে তথ্য-প্রযুক্তি ও প্রথাগত সোর্সের দেওয়া তথ্যমতে, লিটনের দলের অন্য সদস্যদের বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যায়। গোয়েন্দা নজরদারির একপর্যায়ে গত শনিবার (৫ মার্চ) মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকা থেকে এই ডাকাত চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, লোকমান হাকিম ওরফে লিটনের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ সদর থানায় দুটি ও মোকসেদপুর থানায় দুটি ও শিবচর থানায় একটি মামলার তথ্য পেয়েছেন তারা। তার বিরুদ্ধে আরও মামলা আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লোকমান আসলে ডাকাত দলের সরদার হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় সে ডাকাতির জন্য সবকিছু প্রস্তুত করে দিয়ে শিষ্যদের পাঠায়। পরে ডাকাতি করে আনা অর্থের একটি অংশের ভাগ নেয় সে।

ইব্রাহিমও হাফেজি বাদ দিয়ে ডাকাতিতে

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, লোকমান হাকিম ওরফে লিটন শেখের সঙ্গে আরও যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের একজন হলো ইব্রাহিম চৌধুরী। ইব্রাহিমও কোরআনে হাফেজি পড়তো। ১৪ পারা কোরআন মুখস্থ করার পর মাদ্রাসায় পড়া বাদ দিয়ে চুরি-ডাকাতি শুরু করে সে।

জিজ্ঞাসাবাদে ইব্রাহিম জানিয়েছে, তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাঠিবাজার খানারপাড় এলাকায়। বাবার নাম মৃত ফরহাদ চৌধুরী। স্থানীয় গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে পড়তো সে। সেখানে ১৪ পারা কোরআন মুখস্থ করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে। ২০১০ সালে ঢাকায় এসে ছয় নম্বর রুটের বাসে হেলপারি করতো। ২০১২ সালে তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় একটি চুরির মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় মাসখানেক জেল খেটে বের হওয়ার পর গোপালগঞ্জে চলে যায়। গোপালগঞ্জে গিয়ে নিয়মিত চুরি-ডাকাতি করে বেড়াতো। ২০১৮ সালে দুটি বাস থেকে ব্যাটারি চুরি করার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে জেলে যায় সে। ফরিদপুর জেলা কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় লোকমান হাকিম ওরফে লিটন শেখের সঙ্গে পরিচয় হয় তার।

গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, প্রথম দিকে ইব্রাহিম ছিল ছিঁচকে চোর। গাড়ি ও অটোরিকশার ব্যাটারি চুরি করে বেড়াতো। ডাকাত সর্দার লিটন শেখের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে সে সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সদস্য হয়ে ডাকাতি করে বেড়ায়। লিটন শেখের নির্দেশে সে টুঙ্গিপাড়ার কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করার উদ্দেশে রেকি করে এসেছিল। ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে একাধিক পুরনো মামলার তথ্য পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।