বইমেলার নকশা পরিকল্পনাকারী এনামুল করিম নির্ঝর

‘মেলা করবেন নাকি বই বিক্রির হাট বসাবেন?’

এনামুল করিম নির্ঝর একাধারে স্থপতি, চলচ্চিত্রকার, আলোকচিত্রী, গীতিকার, সুরকার ও লেখক। বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করার পর ২০০৭ সালে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আহা!’ নির্মাণ করেন। ছবিটি চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। স্থাপত্যকলার জন্য নির্ঝর পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার। স্থপতি ভাবনাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন ইতিহাস-সমাজ-জীবনের একটা যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে। স্থাপত্য, চলচ্চিত্র আর সংগীতে জড়িত পেশাজীবীদের সৃজনশীল শক্তিকে যতটা সম্ভব মানবিকতার সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে নির্ঝর কোলাবোরেশন। গত চার বছর ধরে বইমেলার পরিকল্পনায় জড়িত এনামুল করিম নির্ঝর। স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে তিনি মেলা প্রাঙ্গণে বিদ্যমান স্থাপত্যশৈলী কাঠামো ব্যবহার করে নকশার কাজটি করেন। মেলা আরও অন্যরকম হতে পারে কিনা, কোনও বিশেষ পরিকল্পনা মাথায় এসেছিল কিনা— সেসব নিয়ে তিনি কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে।

বাংলা ট্রিবিউন: গত কয়েকবছর ধরে মেলার নকশা করে দিচ্ছেন বাংলা একাডেমিকে। পরিবর্তনগুলো কী রকম আনতে পারছেন? কোনও বদল এলো কি?

এনামুল করিম নির্ঝর: প্রথমত, কৃতজ্ঞতা বাংলা একাডেমির প্রতি। কারণ তারা চার বছর ধরে কাজটি করতে দিচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে অনেকেই বুঝতে পারছিলেন না এখানে একজন স্থপতির কাজ কী। ব্যাপারটা এমন, এখানে কিছু দোকান হবে, একমাস ধরে দোকানগুলো থাকবে। কিছু বই বিক্রি হবে। মেলায় আপনি আসবেন, বই দেখবেন, বেছে কিনবেন, বসবেন; সাচ্ছন্দ্যের বিষয়টি বিবেচনায় ছিল না।

অথচ মেলাটা হয় কোথায়? একপাশে বর্ধমান হাউজ মানে বাংলা একাডেমি ভবন। যার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সম্পৃক্ততা, আরেক পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান— যার সঙ্গে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ও বঙ্গবন্ধুর যুক্ততা। পুরো জায়গাটার ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না গন্তব্যটা কোথায়। ফলে প্রতিবারই এই গন্তব্য, এই সাচ্ছন্দ্যটাকে মাথায় রেখে নতুনভাবে ভাবছি।

বাংলা ট্রিবিউন: নকশা করার সময় কখনও থিম ভাবেন?

নির্ঝর: নকশার বিষয়ে সিদ্ধান্তটা এখনও তেমন উন্মুক্ত না। ২০২০ সালে কিছুটা পেরেছিলাম থিম ভাবতে। কেননা সেই বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ সামনে ছিল। সেটা ধরে এগুনো গেছে।

থিম নিয়ে কাজ করার স্কোপ আছে। ধরুন বাংলা একাডেমি উদ্যোক্তা, কিন্তু যে অর্থ দরকার বলে মনে করা হয় সেই বরাদ্দ সরকার দেয় না। ফলে এটা কেবল বই বিক্রির হাট হয়ে গেছে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার। আপনি বই বিক্রির হাট করবেন নাকি মেলা করবেন। যদি মেলা করতে চান—  যদি রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, লেখক, পাঠককে এক জায়গায় আনতে চান তাহলে থিমের বিকল্প নেই।

বাংলা ট্রিবিউন: বলা হয় একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা ভাগাভাগি হওয়ায় বাণিজ্য মনে হয় বেশি?

নির্ঝর: আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশ, বিপুল পাঠক। আপনি পরিসর না বাড়িয়ে কী করবেন। তবে এক্সটেনশনটা অর্থপূর্ণ হতে হবে। একদিকে ভাষা, আরেকদিকে মুক্তিযুদ্ধ মাঝখানে মেট্রোরেল, সড়কপথ। এখন এটা কীভাবে আরও সাচ্ছন্দ্যের করা যায়? কৌশলটা জানতে হবে। পার্কের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ না করে করা যায় কিনা ভাবতে হবে। দুটো এলাকা সংযোগ করে কিছু বানানো যায় কিনা দেখতে হবে। কারণ এই এলাকাটা বাঙালির গন্তব্যে পরিণত হয়েছে—  রমনা, শহীদ মিনার, সোহরাওয়ার্দী, টিএসসি। ফলে এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন লাগবে। একটা মননশীল বিনিয়োগ দরকার ছিল। সেটা মহাপরিকল্নার অংশ হিসেবে সামনে আনা দরকার। এসব না ভেবে, কোন জায়গায় অবদান রাখা যায় তা বিবেচনা না করে শুধু শুধু মন্তব্য তো করাই যায়।

বাংলা ট্রিবিউন: মাঠটা নিয়ে কাজ করার আছে কিনা। মানে একটা স্থায়ী কিছু করা, মাঠটা যাতে নষ্ট না হয়...।

নির্ঝর: আমরা এখানে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে থাকি। বারবার বলি, পয়সা দিতে হবে না। কথা যেটা বলতে চাই সেটা শোনেন, তাহলেই হবে। সুনাগরিক হতে হলে যে পরিচ্ছন্নতা দরকার সেটার অভাব আছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন বৃষ্টির সময় সমস্যা না হয়, ছাউনি দেওয়া আছে স্থায়ী কিছু। পুরো জায়গাটা কমপ্লেক্স আকারে কিছু করা যায় কিনা— যা বছরের অন্য সময় অন্য কাজে ব্যবহৃত হবে— সারা বছরই কোনও না কোনও মেলা হবে— সেটা ভাবার দরকার। বছরজুড়েই উদযাপনের একটা জায়গা হয়ে উঠতে পারে। দৃষ্টিনন্দন করে কিছু করা হোক সেটা ভাবতে চাই, কিন্তু শুনবেটা কে?

ধরুন ন্যাশনাল মিউজিয়ামের কথা। আপনার জয়নুল আবেদীনের একটি মাস্টারপিস ডিসপ্লে করবেন— কিন্তু সেটার জন্য কোনও বাজেট দেবেন না। দুটো লাইট দিলেই হয়ে যাবে? এসবের জন্য একটা ভিশন লাগবে। সীমিত পরিসর, লোকসংখ্যা বেশি, নানা সংকট আছে। সেখানে আর কিছু না হোক মহাপরিকল্পনাটা থাকবে হবে।