স্টল বরাদ্দের শর্তে বাড়ছে ‘জঞ্জাল’ প্রকাশ

প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলায় গড়ে সাড়ে ৩ হাজার বই প্রকাশ হয়। এরমধ্যে মানসম্মত বই ‘খুব বেশি পাওয়া যায় না’ বলে অভিযোগ ওঠে প্রায়শই। অভিযোগ আছে যথাযথ সম্পাদনা নিয়েও। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এখনও সম্পাদনা বলতে কেবল বানান শুদ্ধ করাকে বোঝা হয়। যদিও প্রকাশিত প্রায় সব বইয়েই অসংখ্য বানান ভুল থেকেই যায়। তবে মানহীন বইয়ের জন্য এককভাবে দায় নিতে রাজি নন প্রকাশকরা। তারা বলছেন, স্টল বরাদ্দের সর্বনিম্ন সংখ্যক বইয়ের শর্ত পূরণের জন্যই ‘যা-তা’ প্রকাশের প্রবণতা বাড়ছে। আর এর ফলেই মানহীন এসব ‘জঞ্জাল’-এ ভরে যাচ্ছে স্টলগুলো। এর দায় বাংলা একাডেমিকে নিতে হবে।

এবারের বইমেলার শেষে নতুন বইয়ের তথ্য তুলে ধরে মেলা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ বলেন, বইমেলায় এবার ৩ হাজার ৪১৬টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৯০৯টি বই মানসম্মত। আমরা প্রতি বছর বাংলা একাডেমি থেকে একটি কমিটির মাধ্যমে কতটি বই মানসম্মত হয়, সেটি নির্ধারণ করে থাকি। ২০২০ সালে ৪ হাজার ৯১৯টি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বছর মানসম্মত বই ছিল ৭৫১টি, শতকরা ১৫ শতাংশ ছিল মানসম্মত। এবার মোট প্রকাশিত বইয়ের ২৬ শতাংশ মানসম্মত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালের তুলনায় এবার মানসম্মত বই বেশি প্রকাশ হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, স্টল নিতে আগ্রহী নতুন প্রকাশদের কমপক্ষে ১০টি বই থাকতে হবে। যারা ইউনিট বাড়ানোর আবেদন করবেন, তাদের বছরে ২৫টি বই প্রকাশ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশকদের ওপর এ ধরনের শর্ত দেওয়ার কারণে প্রকাশকরাও যেনতেন পাণ্ডুলিপি দিয়ে ২৫টি বই মুদ্রণ করে জমা দিচ্ছেন।

বিদ্যাপ্রকাশের প্রকাশক মুজিবর রহমান খোকা বলেন, ২৫টি বই প্রকাশ করার শর্ত যদি পূরণ করতে হয়, তাহলে কী দাঁড়ায়? মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান যদি ৪০০টি হয়, আর প্রতিটি প্রকাশককে স্টলের ইউনিট বাড়ানোর জন্য যদি প্রতিবছর ২৫টি করে বই প্রকাশ করতে হয়, তবে বছরে ১০ হাজার বই প্রকাশ হবে। আমাদের দেশে কী প্রতিবছর এত সংখ্যক মানসম্পন্ন বই বের করা সম্ভব? তার চেয়ে বাংলা একাডেমির উচিত ছিল, বইয়ের গুণগতমান যাচাই করে স্টল বরাদ্দ দেওয়া। এতে মানহীন বই খুব সহজে রোধ করা সম্ভব হতো।

বইমেলা-২০২২-ছবি--নাসিরুল-ইসলাম

এই ‘নিয়মের কারণেই’ মানহীন বই প্রকাশ পাচ্ছে বলেই দাবি করেন ভাষাচিত্রের প্রকাশক খন্দকার সোহেলও। তিনি বলেন, পছন্দের জায়গায় স্টল পাওয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম বাধ্যতামূলক করায় নতুন প্রকাশকরা পাণ্ডুলিপি পেলেই প্রকাশ করতে চায়। মানহীন বা মানসম্পন্নের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কোনও মানদণ্ড তৈরি করে দেয়নি। মানসম্মত বইয়ের বিষয়ে কথা বলা মুশকিল। আর মানসম্মত বই প্রকাশের জন্য প্রকাশকদের জন্য মেলায় ছাড়া আর কোনও পুরস্কার নেই। বাংলা একাডেমি মানসম্পন্ন বই কীভাবে বাছাই করে আমরা জানি না। কারা এই কমিটিতে আছেন, সেই কমিটি উন্মুক্ত করা হোক। বাংলা একাডেমির কর্তা ব্যক্তিদের বছরে যে বইগুলো প্রকাশ হয়, সেগুলো কতটুকু মানসম্পন্ন তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।

অমর একুশে বইমেলার পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব জালাল আহমেদের কাছে এই শর্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেসবুকের সমালোচনা আমার চোখে পড়েছে। যারা বলছেন—তারা পুরোটা না বুঝেই কথাগুলো বলছেন। আমাদের শর্ত হচ্ছে—যারা নতুন প্রকাশক, তাদের ৫ বছরে কমপক্ষে ৫০টা বই থাকতে হবে, তারমধ্যে অন্তত ২৫টা মানসম্পন্ন।

তিনি জানান, প্রতিবছর ৭০-৮০ জন নতুন প্রকাশক স্টলের জন্য আবেদন করে। তারমধ্যে ১০-১৫ জন স্টল পেয়ে থাকেন। প্রকাশক প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি আছে, তারা বিষয়টি বিবেচনা করে।

‘নতুন প্রকাশকরা মন্দ বইয়ের সোর্স না’ বলেও দাবি করেন তিনি। তাহলে মানহীন বইয়ের সোর্স কারা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত মৌসুমি প্রকাশকরা এর জন্য দায়ী। অনেক প্রকাশক আছেন, যারা এমন বই ছাপেন—যা ছাপার যোগ্য না। এই সময়টাতে তারা লেখকদের টাকা নিয়ে তার কিছু পরিমাণ খরচ করে বই প্রকাশ করে। বই প্রকাশনা বিশেষ কাজ, কেবল ব্যবসার কাজ না। কিন্তু পাণ্ডুলিপি সবাই বুঝবে না। সম্পাদনার ধারণা প্রায় উঠেই গেছে। ফলে তাদের কাছে যে ভালো ২৫টা বই চাওয়া হয়, সে কয়টা ছাড়া আরও অনেক মানহীন বই আনে তারা। আর এর ফলে মানহীন বইয়ের সংখ্যা বাড়ছে।