পঞ্জিকার খবর কে রাখে?

২০২০ সাল থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধন করে ১৪ এপ্রিল তারিখটিতেই পহেলা বৈশাখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। ঐতিহাসিক দিনগুলোর ক্ষেত্রে ইংরেজি ও বাংলা তারিখে মিল রাখার কারণে সমন্বয় করা হলেও অনেকে এখনও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ‘পঞ্জিকা’ মেনে চলাকেই রীতি জ্ঞান করেন। কিন্তু কী এই পঞ্জিকা? কতজনইবা চেনেন।

বাঙালি জীবনে পঞ্জিকার ব্যবহার কিংবা এর প্রয়োজন নিয়ে বলতে গিয়ে বিশিষ্টজনরা বলছেন, কৃষিতে একসময় বাংলা তারিখের ব্যবহার ছিল। পূজা-পার্বণে এখনও সেই ব্যবহার আছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে পঞ্জিকার ব্যবহার উঠে গেছে বলে তারা মনে করেন না। কেননা পঞ্জিকা কেবল তারিখ নয়। চাঁদের চলনে প্রকৃতির ধরনের মধ্য দিয়ে দিনক্ষণ নির্ধারণ হয় বলে এই চর্চায় থাকলে আত্মিকভাবে প্রকৃতির কাছাকাছিও থাকা যায় বলে মত তাদের।

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বাংলা বর্ষপঞ্জির তারিখগুলোর সমন্বয় করার উদ্দেশ্যে ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা যখন মাতৃভাষার দাবিতে মিছিল করি, দিনটি বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসাবে ৮ ফাল্গুন ছিল। কিন্তু বর্তমান বর্ষপঞ্জিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের সময় সেটি ৯ ফাল্গুনে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবসে পয়লা পৌষ ছিল, যা বর্তমান ক্যালেন্ডারে ২ পৌষ। এসব অসামঞ্জস্য দূর করে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির সঙ্গে বাংলা সনের সমন্বয় করার জন্যই পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু বাকী সবকিছু এখনও গ্রাম বাংলায় পঞ্জিকার মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ এবং ভারতে অনেকগুলো বাংলা পঞ্জিকা প্রচলিত রয়েছে। প্রাচীনতম পঞ্জিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, শ্রী মদনগুপ্তের ফুল পঞ্জিকা, পূর্ণ চন্দ্র শীলের ফুল পঞ্জিকা, লোকনাথ ডাইরেক্টরি নতুন পঞ্জিকা। বইগুলোতে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করন- এই পাঁচ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়। শুভক্ষণ, লগ্ন, রাশিফল জানতে বাঙালি পঞ্জিকার ওপর ভরসা রাখে। আরও জানতে পারেন পালা-পার্বণের খবর। অনেকে একে বলে পাঁজি।

পঞ্জিকা-২

কতরকম পঞ্জিকা

বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা বাঙালিদের কাছে অতি জনপ্রিয় একটি নাম। আজও বাঙালির দিন শুরু হয় পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে। কিছু মানুষ এখনও পঞ্জিকাতে বিশ্বাস রাখেন। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ভারতের বাঙালিদের নিকট খুবই জনপ্রিয় একটি ক্যালেন্ডার। এর পাশাপাশি ভারতে আরও একটি জনপ্রিয় পঞ্জিকা হলো বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা। শ্রী মদনগুপ্তের ফুল পঞ্জিকা প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা পঞ্জিকাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাঙালি হিন্দুদের কাছে এই পঞ্জিকাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যারা প্রতিদিন পূজা করেন বা বিভিন্ন পালা-পার্বণে পূজা সম্পন্ন করেন তাদের মধ্যে মদন গুপ্তের ফুল পঞ্জিকা আজও ব্যবহার হয়। 

বাংলাদেশে লোকনাথের পঞ্জিকা ব্যবহারের চল বেশি। আচার অনুষ্ঠানের জন্য সব পরিবারে এটি থাকে। গ্রামে কৃষি, প্রকৃতির সাথে যারা জড়িত তারা এই পঞ্জিকার ওপর ভর করেই জীবনযাপন করে। পূর্ণ চন্দ্র শীল ফুল পঞ্জিকা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাংলা ক্যালেন্ডার। এখানেও পাঁচটি তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, এখনও দিন শুরু হয় পঞ্জিকা দিয়ে। সনাতন ধর্মে এর প্রচলন বেশি। কিন্তু গ্রামীণ সমাজে সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এর ব্যবহার আছে। বাংলা একাডেমি কালেন্ডার সরলীকরণের মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারিসহ কয়েকটি দিন স্থির করার জন্য যেই উদ্যোগটি নিয়েছে তার সাথে বাঙালির জীবন-যাপন সংস্কৃতির কোনও বিরোধ নেই। এখনও কৃষিকাজের নানা যোগ, লোকজ সংস্কৃতির নানা উদ্যোগের আছে পঞ্জিকায় কী বলছে সেটি দেখে নেওয়ার রেওয়াজ আছে।

বেণীমাধব

পঞ্জিকা শত শত বছর ধরে সনাতন সম্প্রদায়ের যাপনের অংশ বলে মনে করেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, ‘তিথী-লগ্নি এসব দেখে সনাতনরা তাদের দৈনন্দিন ব্যবহার করে। বছরটা কেমন যাবে এগুলো পঞ্জিকা বলে দেয়। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পঞ্জিকার গণনা অনুযায়ী তাদের প্রাত্যাহিক জীবনের ধর্মীয় রীতি-প্রথা পালন করে। বাংলা একাডেমির যে দিন গণনার নিয়ম করলো সেটি তাদের জীবনে কোনও প্রভাব ফেলেনি। ধর্মীয় রীতি-নীতি প্রথা পুরোনো সময়ে যেভাবে পালন করতো সেটাতেই পালন করছে। কেননা তাদের শাস্ত্রীয় আনুগত্য আছে। পঞ্জিকার মধ্যে নবযুগ সবচেয়ে প্রাচীন। ওইটাকে ভিত্তি করে নানা ধর্মীয় সংগঠন পরবর্তী সময়ে নানাধরনের পঞ্জিকা তৈরি করেন।