‘ক্ষতিপূরণে’ ক্ষতি পূরণ হয়?

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে আহত হন হালিমা বেগম। দীর্ঘ শারীরিক অসুস্থতার পর কাজে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু এখনও প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ‘ক্ষতিপূরণের’ নামে যে অর্থ পেয়েছিলেন, তা চিকিৎসার জন্য অপ্রতুল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘না মরলে কোনও ক্ষতি ‍পূরণ হয় না।’

যারা দুর্ঘটনায় নিহত হন, তাদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বেশি থাকে উল্লেখ করে শ্রমিকরা বলছেন, আহতদের আল্লাহর নামে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আজীবন তাদের শারীরিক মানসিক যে ক্ষতি, সেটা পূরণের কোনও উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, দুর্ঘটনার পরে ক্ষতিপূরণের নামে যা বরাদ্দ করা হয়, সেটা আসলে থোক অর্থ বরাদ্দ, একে ক্ষতিপূরণ বলা সঠিক নয়।

যে ক্ষতি বয়ে বেড়াতে হয়

সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের বেশিরভাগের আয় করোনা মহামারির প্রভাবে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ৬৩.৫ শতাংশ বলেছেন, মহামারি চলাকালীন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তাদের কাছে ছিল না। ৫১.৫ শতাংশ বলেছেন, তারা নিয়মিত ঘর ভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি এবং ২২.৫ শতাংশ বলেছেন, তারা সন্তানের সঠিক যত্ন নিতে পারেননি। ৪৬.৫ শতাংশকে মহামারি চলাকালীন তাদের পরিবারের খাবার এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য ঋণ করতে হয়েছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে বেঁচে যাওয়া ২০০ জনের মধ্যে একশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

একশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত জরিপ অনুসারে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকদের ৫৬.৫ শতাংশ বলেছেন, তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে, যা গত বছর ছিল ১৪ শতাংশ। বর্তমান জরিপে ৫৬.৫ শতাংশের মধ্যে যারা তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে বলে জানিয়েছেন, তারা কোমর, মাথা, হাত-পা এবং পিঠে ব্যথাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন।

লাখ টাকায় কোনও ক্ষতি পূরণ হলো?

মো. মনির হোসেন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে আটকে ছিলেন। তিন দিন পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তিনি শরীরের নানারকম জখম নিয়ে আজও  স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। কারখানায় আর ফেরা হয়নিতো বটেই, এখন কিছু সময় কাটান ফুটপাতে নানারকমের ছোটখাটো কাজ নিয়ে। ঘরে খাবার নেই, সন্তানদের পড়ালেখার ব্যবস্থা নেই। মনির দুই দফায় এক লাখ টাকা পেয়েছিলেন। তার প্রশ্ন, কাজে থাকার সময় যে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতেন, তার বিপরীতে এই লাখ টাকা আসলে তার কী সহায়তা করলো।

কেবল মনির নয়, রানা প্লাজাসহ কারখানার নানা দুর্ঘটনায় আহতদের মুখে একই প্রশ্ন শোনা যায় বিভিন্ন সময়। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু আসলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলো কখন বলা যাবে, কী পরিমাণ অর্থ একজন ভিকটিমকে দেওয়া হবে, এ সব বিষয়ে আজও সমাধান হয়নি।

আইন শ্রমিকদের সুযোগের থেকে মালিকদের সুযোগ বেশি উল্লেখ করে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ক্ষতিপূরণের নামে যে থোক বরাদ্দ দেওয়া হয়, সেটা মোটেই যুগপোযোগী না। এই অর্থ দিয়ে আহত শ্রমিকের চিকিৎসা খরচই ওঠে না, সেখানে সে পুনর্বাসিত হবে কীভাবে?’

করণীয় বলতে গিয়ে এই নেতা বলেন, ‘যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, সবই মালিকের অবহেলাজনিত কারণে ঘটেছে। কম মজুরি দিয়ে কাজ করে। মানুষের ওপরে ভর দিয়ে, ঠকিয়ে কোনও ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না। যাদের ওপর ভর করে আয় করছেন, তাদের নিরাপত্তা, বেতনভাতা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নিয়ম থাকতেই হবে।’

ক্ষতিপূরণ একটা ঢাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান। তিনি বলেন, ‘এখানে সব পক্ষের সদিচ্ছার অভাব আছে। আর দুঃখজনক হলো নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এখনও সরকার ও অন্যান্য সম্পৃক্তরা ঠিক করতে পারলো না যে, ক্ষতিপূরণের আইনি কাঠামোর ধরণটা কী হবে। এখানে কী কেবল গার্মেন্টস থাকবে, নাকি অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকের কথা চিন্তা করা হবে। বিষয়গুলো ফয়সালা জরুরি ভিত্তিতে হওয়া দরকার।’