নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হলেও পরীক্ষা বাতিল করেনি মাউশি

নিয়োগ পরীক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগেই ফাঁস হয়েছে প্রশ্নপত্র। প্রশ্নের উত্তরসহ একাধিক আসামিকে গ্রেফতারও করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। কিন্তু ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও সেই পরীক্ষা বাতিল করেনি সংশ্লিষ্ট মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। অভিযোগ উঠেছে, মাউশির একটি চক্র এই নিয়োগের বিনিময়ে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম নেওয়ায় পরীক্ষা বাতিল করছে না। পরীক্ষা বাতিল হয়ে গেলে আগে থেকেই অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার চুক্তি করা প্রার্থীদের অর্থ ফেরত দিতে হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের একাধিক সদস্যকে গ্রেফতার করেছি। তাদের কাছ থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই উত্তরপত্র এসেছিল বলে স্বীকারও করেছে। বিষয়টি মাউশির মহাপরিচালক ও শিক্ষা সচিবকেও জানিয়েছি। পরীক্ষা বাতিল করা না করার বিষয়টি তাদের এখতিয়ার। আমরা তদন্তে যাদের সম্পৃক্ততা পাবো তাদের আইনের আওতায় আনবো।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত শুক্রবার (১৩ মে) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) ৫১৩টি পদে নিয়োগের জন্য লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরীক্ষা চলাকালীন  ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ চাকরি প্রার্থী সুমন জোয়ার্দার নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার প্রবেশপত্রের উল্টো পিঠে ৭০টি এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর লেখা ছিল। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পটুয়াখালীর খেপুপাড়া মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক সাইফুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়। সুমন ও সাইফুলকে একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তারা পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি স্বীকার করে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার রাতে অভিযান চালিয়ে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের প্রভাষক রাশেদুল, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব ও অফিস সহকারী নওশাদকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার (১৮ মে) তাদের দুদিনের রিমান্ডে নিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিয়োগকে কেন্দ্র করে মাউশিতে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই চক্রে মাউশিতে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। সিন্ডিকেট সদস্যদের একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন বহনের দায়িত্বে ছিলেন। প্রশ্নপত্র নিয়ে যাওয়ার সময় তারা প্রশ্নফাঁস করে পরীক্ষার আগেই চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই এমসিকিউ পদ্ধতির ৭০টি প্রশ্নের উত্তর প্রবেশপত্রে লিখে নিয়ে পরীক্ষার হলে ঢুকেছে চাকরি প্রার্থীরা। সিন্ডিকেট সদস্যরা পরিকল্পনা করে পরীক্ষা শুরুর তিন-চার ঘণ্টা আগেই প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নিয়ে যায়। যাতে প্রশ্ন ফাঁসের পর দ্রুত উত্তরপত্র তৈরি করা যায়। উত্তরপত্র তৈরির পরপরই দ্রুত হোয়াটসঅ্যাপে আগে থেকেই চুক্তিবদ্ধ সারা দেশের চাকরি প্রার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মাউশির বিভিন্ন পদে ৫১৩ জন নিয়োগের বিপরীতে এবার চাকরি প্রার্থী ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার। পদ ভেদে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকায় লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করার চুক্তি হয়েছিল। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মাউশির একজন কর্মকর্তা এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। তার বিষয়ে খোঁজ-খবর করা হচ্ছে। এছাড়া এই চক্রে বদরুন্নেসা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজের দুজন কর্মকর্তা-কর্মচারীরও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গোয়েন্দা পুলিশ তাদের গ্রেফতারের জন্য নজরদারি শুরু করেছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহাদত হোসেন সুমা জানান, গ্রেফতারকৃতরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তারা সুমনের কাছে কীভাবে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র এসেছিল তার বিস্তারিত অনুসন্ধান শুরু করেছেন। এ ঘটনায় আরও বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

এদিকে এক সপ্তাহ আগে হাতেনাতে নিয়োগ পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ও উত্তরসহ একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হলেও সেই পরীক্ষা বাতিল করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিয়ে কোনও তদন্ত কমিটিও গঠন করেনি মাউশি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও মাউশির মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ফোন ধরেননি। শিক্ষা সচিব আবু বক্কর সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি ফোন ধরেননি।

এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।