‘এখন যদি বাংলাদেশ থেকে সব আইন উঠিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি মনে হয়— আমরা দায়িত্ব নিয়ে সাংবাদিকতা করবো? কার ঘরে কে কী করছে, দেশের বাইরে থেকে অনেক কন্টেন্ট তৈরি করে বক্তব্য দেওয়া হয়, সেগুলো কি সবসময় সঠিক? অথচ আমাদের দায়িত্বশীল মানুষও সেগুলো সঠিক ভেবে নিচ্ছে। এই দায়বদ্ধতা তো সাংবাদিকদের আছে।’— এমনটাই মনে করেন দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক ও পেন বাংলাদেশের সদস্য মহসীন হাবীব।
শুক্রবার (২০ মে) বিকালে ধানমন্ডির পেন বাংলাদেশ কার্যালয়ে ‘মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
মহসীন হাবীব বলেন, ‘‘প্রেস ফ্রিডম কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতা পুরোপুরি আদায় করা যেমন মুশকিলের ব্যাপার, তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। সেটি হচ্ছে, আমাদের দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। প্রথম দিকে সাংবাদিকতা শুরু করার সময় অনেক আগ্রহ থাকে সবার মধ্যে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকের একটি দিক নির্দেশনা ছিল। উনি বলেছেন— ‘যখনই আপনি প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে আলাপ করবেন, তখন তাকে কোনও অবস্থাতেই বিল পরিশোধ করতে দেবেন না। না হলে তাতে আপনি দায়বদ্ধ হয়ে যাবেন।’ একসময় বাংলাদেশে মাত্র ৩-৪টি পত্রিকা ছিল, এখন তিন-চার হাজার পত্রিকা। আমরা যারা সাংবাদিক হচ্ছি, তারা কতটা দায়বদ্ধতা নিয়ে… কীভাবে আমাদের নিয়োগ হচ্ছে, সেটিও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ।’’
মহসীন হাবীব বলেন, ‘আমি গ্রাম থেকে এসেছি, একজন সুযোগ দিয়েছে সাংবাদিক হয়ে গেছি, এর বাইরে আমার দায়বদ্ধতা কী। এরপর ধীরে ধীরে আমি বড়দের কাছ থেকে শিখবো— এই শেখাটা কতটুকু হচ্ছে, সেটিও প্রশ্নবিদ্ধ।’
পেন ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বের ৩৬টি দেশে ২৭৭ জন লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী নির্যাতনের শিকার এবং বর্তমানে কারাবন্দি আছেন। ২০২০ সালে ২৭৩ জন কারাবন্দি ছিলেন এবং তার মধ্যে অনেকে এখনও বন্দি অবস্থায় আছেন। পেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম টু রাইটস ইনডেক্সের রিপোর্ট ২০২১ অনুযায়ী, বর্তমানে মিয়ানমার, সৌদি আরব, ইরান এবং চীন লেখক-সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বড় কারাগার হিসেবে উঠে এসেছে।
পেন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক কথাসাহিত্যিক মুহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমরা গত বছর দেখেছি, তুরস্কে লেখকদের অনেক বেশি কারাবন্দি করা হয়েছে। গত বছর তুরস্কে নতুন করে ৫০টি কারাগার তৈরি করা হয়েছে, সরকারবিরোধী মত প্রকাশ যারা করেন, তাদের দমন করার জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও আমাদের ওপর বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ আসছে এবং আসে বলে আমরা মনে করি। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে কয়েকটি আলোচ্য বিষয় আমি তুলে ধরতে চাই, এর মধ্যে আছে— সংবাদপত্রে করপোরেট মালিকানা ও তাদের স্বার্থের প্রতিফলন, সরকারের রাজনৈতিক চাপ, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সরকারের গোপনীয়তা আইন এবং সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা।’
আলোচনার সঞ্চালক বাংলা ট্রিবিউনের প্রধান প্রতিবেদক উদিসা ইসলাম এসময় দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘আইনের ভেতরে সাংবাদিকরা কীভাবে দায়বদ্ধ থাকবে, বিষয়টি জটিল মনে হচ্ছে। আমি ২০-২৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছি, আমি নিজেই পরিষ্কার নই যে, এটি কীভাবে সম্ভব।’
পেন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি কবি শামীম রেজা বলেন, ‘আমাদের দেশে যে ছয় ঋতু আছে, তার কারণেই কিন্তু প্রতিটি মানুষ লেখক। ষষ্ঠ ঋতুর দেশ দেখার জন্যই কিন্তু কয়েক লাখ দর্শক দেশে আসতো। এখন ভিজিটর কীভাবে আনবো? আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সন্ধ্যার পরই সেন্ট মার্টিনেই বলা হচ্ছে— আপনারা হোটেলে ফিরে যান। একদিকে আমরা নারীকে স্বাধীনতার কথা বলছি, উল্টো দিকে আমরা চার দেয়ালের ঘরে হাত মোজা পড়ানোর জন্য আমি বসে আছি।’
সভাপতির বক্তব্যে ধন্যবাদ জানিয়ে পেন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি আহমেদ রেজা বলেন, ‘বাংলাদেশ বেতারের স্বাধীনতা থাক কিংবা না থাক, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর কিন্তু বাংলাদেশ বেতারই প্রচার করেছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অশ্রাব্য কিছু বলা হয়নি। খুবই নিরাশক্ত একটি ভাষায় হত্যার খবর প্রচার করা হয়েছিল। আমি বলছি না, বাংলাদেশ বেতারের স্বাধীনতা আছে। আবার সেরকম পরাধীনও নয়, যেমনটা বিবিসি। আমি গিয়েছিলাম সেখানে। আমি জেনেছি যে, বিবিসিকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের খবর দেখলে বুঝা যায় যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৮০ শতাংশ চিন্তার প্রতিফলন আছে সেখানে। আমি আমার বন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভয়েজ অব আমেরিকা কীরকম স্বাধীনতা ভোগ করে। জানতে পারলাম যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব অ্যাফেয়ার্সের অধীনে তারা।’
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন— সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক লাভলী তালুকদার, কবি জাহিদ সোহাগ, ড. সুরাইয়া ফারজানা প্রমুখ।
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন