মাল্টিপারপাসের নামে ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

আকর্ষণীয় লভ্যাংশের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর গোলাপ মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটিতে একই পরিবারের লোকজন দিয়ে কমিটি গঠন করে এ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরের মনিপুর এলাকার ৭০৩/১ নম্বর বাসায় পরিচালিত হয়ে আসছিল মাল্টিপারপাসটির কার্যক্রম। ২০১১ সালে এক বিশেষ সাধারণ সভায় ‘নির্বাচনের প্রয়োজন নেই’ সিদ্ধান্ত নিয়ে কমিটি গঠন করে গোলাপ মাল্টিপারপাস।

গ্রাহকদের অভিযোগ- মেয়াদের পর তারা তাদের আসল টাকা ফেরত চাইলে তাদের হয়রানি ও নাজেহাল করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির সহ-সভাপতি কুদ্দুস আলী এবং সভাপতি খলিলুর রহমান (কুদ্দুসের বোনজামাই) এর নেপথ্যে আছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।

একই অভিযোগ প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন ও কোষাধ্যক্ষ নান্নু মিয়ার বিরুদ্ধেও। ইতোমধ্যে কয়েকজন গ্রাহক এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।

গোলাপ মাল্টিপারপাসের তালাবদ্ধ অফিস

ভুক্তভোগীরা বলছেন, কয়েকবার মুনাফা দিয়েছিল তারা। এরপর শুরু হয় টালবাহানা। পরে আসল টাকা চাইতে গেলেও ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। দেখায় ভয়-ভীতি।

গ্রাহকদের আশঙ্কা, মাল্টিপারপাসটির লোকজন যেকোনও সময় গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দিতে পারে।

খলিলুর রহমান ও কুদ্দুস মিয়ার সন্তানরা দেশের বাইরে থাকেন এবং তারা টাকা পাচার করছেন বলেও অভিযোগ করেন কয়েকজন গ্রাহক।

টাকা জমা রাখার চার-পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও অনেককে তা ফেরত দিচ্ছে না গোলাপ মাল্টিপারপাস কর্তৃপক্ষ।

মিরপুর ২ নম্বর পশ্চিম মনিপুরের গোলাপ মাল্টিপারপাস সোসাইটির ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, ৩৪ পশ্চিম মনিপুর সাততলা ভবনটির মালিক কুদ্দুস মিয়া। তার ভবনের নিচতলায় একটি রুমে পরিচালিত হয়ে আসছিল গোলাপ মাল্টিপারপাসের কার্যক্রম। এখন তা বন্ধ। সাইনবোর্ড ফেলে রাখা একপাশে।

দারোয়ান ইদ্রিস মিয়া জানালেন, এটি কুদ্দুস সাহেবের বাড়ি। তিনি এখানে থাকেন না। তার আরও কয়েকটি বাড়ি আছে। কুদ্দুসের একটি আবাসন ব্যবসা রয়েছে বলেও জানান তিনি।

গোলাপ মাল্টিপারপাসের সভাপতি খলিলুর রহমানের বাসার ঠিকানা অনুযায়ী গিয়ে দেখা যায়, ৮১৯/২ মনিপুর ঠিকানার ভবনটির মালিকানা তার। তিনতলায় পরিবারসহ থাকেন। কয়েক দফায় তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। কয়েক দফা ফোন করেও তার সাড়া মেলেনি। এরপর তার মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গোলাপ মাল্টিপারপাস-এর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আছেন আট সদস্য। সভাপতি খলিলুর রহমান, সহ-সভাপতি কুদ্দুস আলী, খলিলুর রহমানের স্ত্রী রাবেয়া বেগম সদস্য, বোন নাসিমা আখতার যুগ্ম সম্পাদক, ইকবাল হোসেন কোষাধ্যক্ষ, ফাতেমা আফরিন সদস্য ও আবুল কালাম নামের আরেকজন সদস্য পদে রয়েছেন। এরা সবাই এক পরিবারের সদস্য।

সমাজসেবা অধিদফতরের প্রতিবেদন বলছে, গোলাপ মাল্টিপারপাসের খাতাপত্র সংরক্ষণ করা থাকলেও সাধারণ খতিয়ান লেখা হয়নি। মাল্টিপারপাসটির মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও যমুনা ব্যাংকের দুটি হিসাবে গরমিল পাওয়া গেছে। সমিতির আর্থিক অনিময় এবং টাকা সরানোর বিষয়টি সম্পর্কেও অবহিত আছে অধিদফতর।

এরই মধ্যে সমিতির মূলধন ও সদস্যদের জমাকৃত টাকার সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত এবং সমস্ত লেনদেন ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটিকে পরামর্শও দেওয়া হয়েছে অধিদফতরের পক্ষ থেকে।

ভুক্তভোগী গ্রাহক আজিজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার প্রায় দুই লাখ টাকা ছিল।‌ টাকা ওঠাতে গেলে তারা নাজেহাল করে। পরিবারটি একজোট হয়ে আমাদের মতো গ্রাহকদের নিঃস্ব করার পাঁয়তারা করছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চাই।

ভুক্তভোগী আরেক গ্রাহক রুমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নিজের টাকা ওঠাতে এভাবে অপদস্ত হবো ভাবিনি। অনেক কষ্ট করে জমানো ২ লাখ টাকা দিয়েছিলাম গোলাপ মাল্টিপারপাসে। টাকা আত্মসাৎ করে তারা বাড়ি-গাড়ি করেছে।

১৮ লাখ টাকা জমা রাখা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক জানালেন, ওরা যেকোনও সময় বিদেশে পালাতে পারে। আমরা চাই আমাদের টাকা দ্রুত পরিশোধ করে দিক। এই প্রতারক চক্রের হাত থেকে রেহাই পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

গোলাপ মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে করা সাধারণ ডায়েরির তদন্ত করছেন মিরপুর মডেল থানার এসআই মো. শফিক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, টাকা না পাওয়ার কারণে গোলাপ মাল্টিপারপাসের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকজন জিডি করেছেন। আমরা তদন্তের জন্য কোর্টে আবেদন করেছি। এখনও নির্দেশনা পাইনি।

মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাজিরুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা ভুক্তভোগীদের মামলা করার কথা জানিয়েছি। তবে এখনও কেউ মামলা করেননি।

গোলাপ মাল্টিপারপাসের সহ-সভাপতি কুদ্দুস মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গ্রাহকের টাকা সরানোয় তার হাত নেই। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি খলিলুর রহমানকে দায়ী করেন। খলিলুর রহমান এককভাবে টাকা সরিয়েছেন বলেও জানান তিনি। তবে কমিটির অন্য সদস্যদের সহায়তা ছাড়া কীভাবে খলিল একাই টাকা তুললেন এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি কুদ্দুস।

খলিলুর রহমানকে বাসায় না পেয়ে তার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার কল করেও সাড়া মেলেনি। পরে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো গ্রাহকদের ওপর দায় চাপান। গ্রাহকরা লাভবান হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি খলিলুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাকে পাচ্ছি না। তিনি ঢাকার বাইরে।

অন্য কারও অনুমোদন ছাড়া খলিলুর কী করে টাকা নিলেন এর উত্তর আলমগীর হোসেনও দিতে পারেননি।

বিভিন্ন সময় এ ধরনের অর্থ আত্মসাৎকারী মাল্টিপারপাসে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে আমরা তদন্ত করবো।