চেক ডিজঅনারের মামলায় কোনও ব্যক্তিকে জেলে পাঠানো সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলা হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক বেঞ্চের সইয়ের পর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট এ-সংক্রান্ত বেশ কিছু মামলা নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে চেক ডিজঅনারের মামলায় কোনও ব্যক্তিকে জেলে পাঠানো সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দেন হাইকোর্ট। সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’
আদালত তার রায়ে বলেন, নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধন করে চেক ডিজঅনারের মামলায় জেলে পাঠানোর বিধান বাতিল করার জন্য জাতীয় সংসদকে পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত চেক ডিজঅনারের মামলা নিষ্পত্তির জন্য একটি গাইডলাইন করে দিয়েছেন আদালত।
রায়ে বলা হয়, কোনও ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা সংবিধান পরিপন্থী। নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলায় কোনও ব্যক্তিকে কারাগারে বন্দি রাখা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হরণের নামান্তর। চেক ডিজঅনার মামলায় কোনও ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠানো বা কারাগারে রাখা সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী এবং ইন্টারন্যাশনাল কভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসের (ওএইচসিএইচআর) ১১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী। বাংলাদেশ ওএইচসিএইচআরের সই করা দেশ হিসেবে চেক ডিজঅনার মামলায় কোনও ব্যক্তিকে কারাগারে পাঠাতে পারে না।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে আদালত বলেন, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চেক ডিজঅনার মামলায় জেলে পাঠানোর বিধান নেই। এসব দেশে চেক ডিজঅনারের মামলাগুলোকে দেওয়ানি প্রকৃতির মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৯৯৪ সালে পেনাল কোড সংযোজনের মাধ্যমে আধা ফৌজদারি হিসেবে পরিণত করা হয়েছে।
কন্ট্রাকচ্যুয়াল অব নেগোসিয়েশন বা চুক্তিগত দায়দায়িত্ব পূরণের ব্যর্থতার জন্য কোনও ব্যক্তিকে কারাগারে বন্দি রাখা যাবে না। এ ব্যর্থতার জন্য যদি কারাগারে পাঠানো হয়, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ কারাগারে চলে যাবে। এটা কারও কাম্য নয়।
‘নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা দ্রুত সংশোধন করে কারাগারে পাঠানোর বিধান বাতিল করা আবশ্যক। আদালত প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, জাতীয় সংসদ অতি দ্রুত নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধন করবে বলে আমাদের (হাইকোর্ট) প্রত্যাশা।’
আদালত আরও বলেন, জাতীয় সংসদ যত দিন ১৩৮ ধারার সংশোধন না করে বা সংশোধনী না আনা হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার আওতায় চেক ডিজঅনারের মামলা আপসযোগ্য হবে। চেক ডিজঅনারের মামলা বিচারের এখতিয়ারসম্পন্ন দেশের সব আদালতে সাজার পরিবর্তে তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানা দিতে পারবে।
আদালত তার এই রায়ের অনুলিপি দেশের সব আদালতে এবং আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোরও নির্দেশনা দেন।
পরে হাইকোর্টের রায়টি স্থগিত চেয়ে আবেদন জানায় রাষ্ট্রপক্ষ। সে আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি মো. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন চেম্বার জজ আদালত হাইকোর্টের রায়টি আগামী ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন। এরপর এ বিষয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হবে।