বেদখলে ঢাকার প্রথম পানির ট্যাংক, নজর নেই ওয়াসার

১৮ শতকের মাঝামাঝি পাইপলাইনে পানি সরবরাহের জন্য নির্মিত ঢাকার প্রথম ট্যাংকটি এখন দখলদারদের কবজায়। ট্যাংকের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মাজার। মাজারের নামে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। সম্পত্তি বেহাত হলেও নজর নেই ঢাকা ওয়াসার। দেড় শ বছরের পুরাতন এই সম্পত্তি সম্পর্কে জানা নেই প্রত্নতত্ত্ব বিভাগেরও।

সরেজমিনে দেখা যায়, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর দিকে ও কবি নজরুল কলেজের পশ্চিম পাশে সড়কের সাথেই কলতাবাজারে অবস্থান পানির ট্যাংকটির। ট্যাংকটি এখন আর ব্যবহৃত হয় না, অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ট্যাংকের নিচের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে মাজার। স্থাপনাটির একপাশের প্রাচীর ভেঙে করা হয়েছে মাজারে ঢোকার গেট। কলাপসিবল গেটে ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা আছে—শাখা দায়েরায় মূসাবীয়া কলতাবাজার। ভেতরে ঢোকার মুখে কাচের দরজা। রয়েছে ৩টি কক্ষ। একটিতে বসার ব্যবস্থা, একটিতে থাকার এবং একটিতে বসে গানের আসর। প্রবেশদ্বার থেকে পুরো অংশই টাইলসে মোড়ানো। ট্যাংকের বাইরের অংশে বসানো হয়েছে খাবার হোটেলসহ কয়েকটি ছোটো দোকান।IMG_20221107_124112

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ট্যাংকের সাথে গড়ে ওঠা দোকানগুলো থেকে দোকান ভাড়ার নামে মোটা অঙ্কের চাঁদা তুলে মাজারের লোকজন। প্রভাব খাটিয়ে মাজারের লোকজন পাশের লবণের গলিতে বসান সবজির বাজার। এছাড়াও সন্ধ্যার পর চটপটি-ফুচকার দোকান, ডিমের দোকান থেকেও তোলা হয় চাঁদা। দৈনিক ও মাসিক চুক্তিতে এসব দোকান ও সবজি বিক্রেতাদের থেকে তোলা হয় ১০০ থেকে ৫ হাজার টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলেন, 'মাজারের লোকজন থেকে আমরা দোকান ভাড়া নিয়েছি। ওনাদের সাথে মাসচুক্তি। জায়গা যে মাজারের না আমরাও জানি। শুনেছি ওয়াসার জায়গা এটা। প্রশাসন কিছু বলে না, মাজারের লোকজনই এসব জায়গা নিয়ন্ত্রণ করে, টাকা তোলে দোকানিদের থেকে।'IMG_20221107_124228

পাশেই সিটি করপোরেশন মার্কেটের অপর এক দোকানি রুহুল বলেন, 'জায়গাটা ওয়াসার, এরা এখন দখল করে আছে। ট্যাংকের আশেপাশে যত দোকান আছে টাকা তোলে, ওদের অনুমতি না নিয়ে কেউ দোকান বসতে পারে না এখানে। সবজির দোকান বসে, রাস্তায় জ্যাম তৈরি হয়। ভেতরে মাদকের আসর বসে, অনেক মহিলাও এখানে আসে দেখি।'

মাজারের খাদেম মোহাম্মদ নবী হক বলেন, ‘এখানকার প্রধান খাদেম মো. সোহেল, যিনি এখানে সপ্তাহে একদিন আসেন। এছাড়াও আমরা ১০ জন খাদেম আছি। বাৎসরিক ওরশ মাহফিল আয়োজন করি আমরা।'

জায়গা দখল ও চাঁদা তোলা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখানে শুরু থেকেই মাজার আছে। আর আশেপাশের দোকানিরা মাজারের ভক্ত, তারা খুশি হয়ে টাকা দেয়।'IMG_20221107_124242

এ বিষয়ে কথা বলতে ৪২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. সেলিমকে মুঠোফোনে বারবার ফোন দেওয়া হলেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ.কে.এম শহীদ উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'ওই ট্যাংকটা এখন অব্যবহৃত অবস্থায় আছে। দখলের বিষয়টা আমার জানা নেই। আমরা দেখবো বিষয়টা, তেমন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

খন্দকার মাহমুদুল হাসান তার ‘বাংলাদেশের প্রথম ও প্রাচীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর পৌরবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য নবাব পরিবার আর্থিক সহায়তায় করে। ফলে ১৮৭৮ সালের ২৪ মে থেকে ঢাকাবাসীকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হয়। পানি সরবরাহের জন্য পানির ট্যাংকটি নির্মিত হয়েছিল।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, ঢাকায় ১৮টি পুরাকীর্তির তালিকা থাকলেও, এতে নেই ঢাকার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা এই পানির ট্যাংকটি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শহীদ কাদের চৌধুরী বলেন, 'ঢাকাসহ সারাদেশেই প্রাচীন নিদর্শনগুলো বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এগুলো রক্ষা করা জরুরি। আমরা যে পুরান ঢাকার কথা বলছি, ৪০০-৫০০ বছরের ইতিহাসের কথা বলছি—সেই ইতিহাসটা আসলে কী? এই ছোটো ছোটো বিষয়গুলোই, ঢাকার বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোই এর পরিচয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে এগুলো রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। এগুলোর তালিকা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।'

এ বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের উপপরিচালক মাইনুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, 'এটা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অন্তর্ভুক্ত কিনা জানা নেই। ওয়েবসাইটে আমাদের অন্তর্ভুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর তালিকা আছে। এটা যদি অন্তর্ভুক্ত করতে হয় তাহলে যে কেউ আবেদন করতে পারবেন। আবেদন পেলে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারবো।'