সরেজমিন মতিঝিল থানা

ভবন জীর্ণ হলেও সেবায় আধুনিক

রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিল। বহু সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও বিমা কোম্পানির অফিসসহ অন্যান্য সরকারি দফতর রয়েছে এ থানা এলাকায়। এই থানায় হারানোর সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হচ্ছে বেশি। তবে সেবা নিয়ে কোনও অভিযোগ করেনি ভুক্তভোগীরা। পরে থানা ঘুরে অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মিলেছে।

বৃহস্পতিবার (১৭ নভেম্বর) সকাল ১১টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত মতিঝিল থানায় সরেজমিন থেকে এ চিত্র দেখা গেছে। দৈনিক বাংলা মোড় থেকে সোজা মতিঝিল শাপলা চত্বরের দিকে যেতেই একটু সামনে বায়ের গলির মধ্যে মতিঝিল থানার ভবন। বিআইডব্লিউটিএ ও জীবন বীমা দুই অফিসের মাঝখানে রাস্তা ঘেঁষা দ্বিতলবিশিষ্ট থানা ভবনটি।

তবে মতিঝিল থানায় কর্তব্যরত এক অফিসার অভিযোগ করে বলেন, এমন জরাজীর্ণ থানা ভবন ডিএমপিতে আর মনে হয় একটিও নেই। পুরাতন একটি ভবনে দীর্ঘদিন ধরে চলছে থানার কার্যক্রম। নিচে থানার কার্যক্রম চললেও উপরে টিনশেড দিয়ে ঘেরা রুমেই থাকেন পুলিশ সদস্যরা। ভবন পরিদর্শন করে এর প্রমাণও মেলে।image(21)

ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মতিঝিল থানা বর্তমানে যেখানে আছে, ওই জমিটা নিয়ে আইনি ঝামেলা থাকায় নতুন করে কিছু ভাবা যাচ্ছে না। তবে ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ‘মতিঝিল বিভাগে সাতটি থানা আছে। এরমধ্যে পল্টন ও শাহজাহানপুরসহ বেশ কয়টি থানা সংস্কার করা হয়েছে। আর মতিঝিল, সবুজবাগসহ বাকি থানাগুলো পর্যায়ক্রমে সংস্কার করা হচ্ছে।’

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, থানার সামনে পড়ে আছে একটি দুমড়ানো-মুচড়ানো সিএনজি, দুটি মিনি ট্রাক, সাতটি প্রাইভেট কার ও একটি লেগুনাসহ বেশ কিছু মোটরসাইকেল। বিভিন্ন ঘটনায় জব্দ করা গাড়ি থানার সামনে রাখায় এগুলো পথচারীদের চলাচলে দুর্ভোগের কারণ হয়ে আছে।image(23)

রাস্তা সংলগ্ন থানার প্রধান ফটকে অস্ত্র নিয়ে দুজন সিপাহীকে ডিউটি করতে দেখা গেছে। ভুক্তভোগীরা থানায় প্রবেশ করতেই জানতে চাইলেন—‘কোথায় আসছেন, কোন অফিসারের কাছে যাবেন।’ উত্তর পেয়েই তারা সুন্দরভাবে বলে দিচ্ছেন কোথায় গেলে পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত অফিসারকে। দেখিয়ে দিয়েছেন ডিউটি অফিসারের কক্ষটিও।

৪টি জিডির গল্প

সরেজমিন অবস্থানকালে দুপুরে একটি অভিযোগ নিয়ে আসতে দেখা যায় বরিশাল বাকেরগঞ্জের আবদুল মান্নানকে (৫৬)। ঢাকায় রিকশাচালান তিনি। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ৩৬ বছরের সংসার জীবনে ছয় মেয়ে, এক ছেলে তার। এরমধ্যে চার মেয়ে বিবাহিত আর দুই মেয়ের বিয়ের বয়স হলেও বিয়ে দেননি এখনও। আর ছেলে একটি জুতার কারখানায় চাকরি করে। এত বড় সংসার রিকশার প্যাডেলে আর টানতে না পারায় গত এক বছর চার মাস আগে স্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন ওমান। সেখানে ভালো আছে, বেতনও ঠিক মতো পেতো। এতদিন স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভালো ছিলাম জানিয়ে তিনি বলেন, ধার-দেনা করে বিদেশে পাঠানো স্ত্রীর টাকায় সব দেনা শোধ করেছি। এখন ঢাকা থেকে বাড়িতে গিয়ে ঘর করে বাকি জীবন কাটানোর ইচ্ছাটা আর পূরণ হলো না। শুনছি—স্ত্রী নাকি তার চাচাতো বোনের ছেলের সাথে পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়েছে। তারা নাকি অনলাইনে বিয়েও করেছে। আমাকে তালাক দিয়েছে—এমন একটি কাগজের কপিও পাঠিয়েছে। কাজীকে দেখালে তিনি বলেছেন, এই তালাক হয়নি।

আমার স্ত্রী তালাক দিক সমস্যা নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিষয় হলো—এখন আমার মেয়েদের সংসার টিকানো দায়। এরমধ্যে এক মেয়েকে জামাই আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন থানায় এসেছি আমার স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া করা সেই ব্যক্তির নামে মামলা করতে।

এরআগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাকিব হোসেন নামে এক যুবকের সঙ্গে তাসলিমা আক্তার নামে এক নারীকে থানা থেকে বের হয়ে যেতে দেখে এগিয়ে যায় এই প্রতিনিধি। কী সমস্যা নিয়ে থানায় এসেছিলেন—জানতে চাইলে তাসলিমা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গতকাল বুধবার সাভার থেকে ফকিরাপুলে একটা বিদেশি অফিসে এসেছিলাম পাসপোর্ট জমা দিতে, কিন্তু আসার পথে গাড়িতে পাসপোর্টটি হারিয়ে গেছে। এজন্য আজ মতিঝিল থানায় হারানোর জিডি করলাম।

তিনি বলেন, সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দিতে এসে হারিয়ে ফেলেছি। এখন খারাপ লাগছে কিন্তু কিছু করার নেই। আবার নতুন করে করতে হবে।

থানায় অফিসাররা আপনাদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করলো— জানতে চাইলে তাসলিমা আক্তার বলেন, জিডি করার জন্য থানায় আসলে অফিসাররা অনেক সহযোগিতা করেছেন। তারা নিজেরাই জিডির ফরম পূরণ করে দিয়েছেন। আমি শুধু সই করেছি। মতিঝিল থানার অফিসার অনেক ভালো।

এর কিছুক্ষণ পর থানায় আসেন আব্দুর রশিদ নামে আরও এক ভুক্তভোগী। কীসের জন্য থানায় এসেছেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজ সকালে আমার পাসপোর্ট হারিয়ে যাওয়ায় জিডি করতে আসলাম।’ এছাড়া গোলাম সারোয়ার নামে একজন ঠিকাদারি ব্যবসায়ী এসেছেন ট্রেড লাইসেন্স হারিয়ে যাওয়ার জিডি করতে।

তবে দুপুর ২টার পরে ফকিরাপুল কোমরগলির এক বাসিন্দা মাথায় ব্যান্ডেজ করা অবস্থায় থানায় আসেন, সঙ্গে এক তরুণী। তাদের অভিযোগ, পাশের ফ্ল্যাটের মহিলার সাথে ঝগড়াঝাঁটি হওয়ার এক পর্যায়ে তাদেরকে মারধর করা হয়েছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে থানায় এসেছেন মামলা করতে। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ডিউটিরত পুলিশ সদস্যরা ওই নারীর ঘটনা শুনে মামলা গ্রহণ করেন। এছাড়া জিয়াউর রহমান নামে ফকিরাপুলের স্থানীয় এক বাড়ির মালিক এসেছেন বাসা ভাড়া নিয়ে পারিবারিক ঝামেলা চলছে, এমন ঘটনার জিডি করতে।

জনসাধারণের জন্য খাবার পানি ও হাত ধোয়ার বেসিন315919718_848198869858571_8137015360834017431_n

থানার বাইরে দেখা গেলো ব্যতিক্রমী এক চিত্র। থানায় আসা ভুক্তভোগীদের জন্য থানার সামনেই রাখা আছে খাবার পানির একটি ট্যাংক। হাত ধোয়ার জন্য রয়েছে বেসিন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে দিনে ও রাতে দুইবার থানার অফিসারসহ অন্য সদস্যদের জন্য ভ্রাম্যমাণ ট্যাংকে করে পানি নিয়ে আসা হয়। সেই ট্যাংক রাখা হয় থানার সামনে। আশপাশের অফিসের লোকজন ও রিকশাচালকসহ ভাসমান মানুষকে ট্যাংক থেকে পানি নিতে দেখা গেছে।

রিকশাচালক আব্দুর রউফকে থানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় নেমে ওই ট্যাংক থেকে বোতলে পানি ভরতে দেখা গেছে। একটু কাছে গিয়ে ছবি তুলতেই বলেন, পত্রিকায় দিবেন বুঝি? বললাম, হ্যাঁ।

পরে আব্দুর রউফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানার সামনের পানির ট্যাংক থেকে প্রায়ই পানি নেই। পুলিশ কিছু বলে না‌। এছাড়া এই পানির মানও ভালো।314100812_522027046230701_3269064776955617697_n

পানি নিতে আসা থানার পাশের এক অফিসের কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মামুন বলেন, এই পানি পুলিশের জন্য নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এখানকার দোকানদারসহ ভাসমান মানুষজন এই পানি পান করে। এতে পুলিশ সদস্যরা কাউকে কিছু বলে না। আমার অফিস পাশে কিন্তু প্রায় দুপুরে খাওয়ার সময় এখান থেকে পানি নিয়ে যাই। কেনা পানির চেয়ে এটা খুব ভালো।

তাদের মতো এমন অনেক মানুষকেই এখান থেকে পানি নিতে দেখা যায়। এ বিষয়ে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘এটা পুলিশ সদস্যদের জন্য নিয়ে আসা হলেও সবার জন্য উন্মুক্ত। পানি নিতে কাউকে নিষেধ করা হয় না। সাধারণ মানুষ পুলিশের পানি স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করছেন।’image(22)

থানার প্রধান দরজার উপরে তিন দিকে মুখ করে তিনটি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। থানার সামনের রাস্তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হয়।

মন খারাপ শাহজাহান মিয়ার

থানায় একটি ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে। শাহজাহান মিয়া নামে এক ব্যক্তি মন খারাপ করে হচ্ছেন দেখে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতেই বললেন, পল্টন থানা কোন দিকে বলতে পারবেন। কারণ জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, দৈনিক বাংলা মোড়ে আমার একটি মোবাইল ফোন হারিয়ে গেছে। মতিঝিল থানায় আসছিলাম জিডি করতে, কিন্তু থানা থেকে বললো ঘটনাস্থল পল্টন থানা এরিয়ায়। এখন ওই থানায় যেতে হবে।

থানায় কোন বিষয়ে বেশি অভিযোগ আসছে জানতে চাইলে ওসি ইয়াসিন আরাফাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা হওয়ায় এ থানায় প্রতারণা ও টাকা আত্মসাৎসহ মাদক মামলা হচ্ছে বেশি। আর হারিয়ে যাওয়ার জিডির সংখ্যাও বাড়ছে। তবে এরমধ্যে পাসপোর্ট হারানোর অভিযোগই বেশি। কিন্তু চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা খুবই কম।

থানা ভবনের জীর্ণ অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে ওসি ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘মতিঝিল থানার এই জায়গাটি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। এজন্য এখানে নতুন কোনও কিছু চিন্তা করা যাচ্ছে না। সরকার তো সবসময়ই পুলিশের বিষয়ে আন্তরিক, কিন্তু ঝামেলা থাকায় কিছু করতে পারছে না।’

আরও পড়ুন:

ধানমন্ডিতে ছিনতাই বেড়েছে, ওসি বলছেন চুরি