বিমানের হিসাব নিয়ন্ত্রক দেখালেন আয়, উল্টো ক্ষতি হাজার কোটি

কোনও উড়োজাহাজ লিজ নিতে হলে দরপত্র আহ্বান করে প্রফিট্যাবিলিটি স্টেটমেন্ট, ফিজিক্যাল ইন্সপেকশন, এয়ারওর্দিনেস সার্টিফিকেট যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে। সন্তোষজনক প্রতিবেদন পেলে দরপত্রে উল্লেখিত স্পেসিফিকেশন মোতাবেক উড়োজাহাজ প্রস্তুত থাকলে অ্যাকসেপ্টেন্স সার্টিফিকেট দিয়ে গ্রহণ করতে হবে উড়োজাহাজ। তবে মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ পাঁচ বছরের জন্য লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব পদ্ধতি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। সে সময়ে বিমানের হিসাব নিয়ন্ত্রক মঞ্জুর ইমাম উড়োজাহাজ দুটি লিজ নিলে বিমান ৩২ হাজার ৪৪১ ডলার আয় করতে সক্ষম হবে বলে প্রফিট্যাবিলিটি স্টেটমেন্ট দেন। যদিও বাস্তবতা উল্টো, এটির কারণে বিমানের লোকসান হয়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকা।

জানা গেছে, মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ লিজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ২৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা (মামলা নম্বর ১/৬.২.২০২৩) করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরমধ্যে বিমানের কর্মকর্তা ২২ জন আর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা একজন। অসৎ উদ্দেশ্যে মিসরের ইজিপ্টএয়ারের কাছ থেকে লিজ গ্রহণের সুযোগ করতে ফিজিক্যাল ইন্সপেকশন, এয়ারওর্দিনেস সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য প্রতিবেদন দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। যদিও মনগড়া প্রফিট্যাবিলিটি স্টেটমেন্ট দেওয়া হিসাব নিয়ন্ত্রক মঞ্জুর ইমামের নাম এজাহারে নেই।

দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, বিমানের লিজের বিষয়ে অভিযোগের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে তাদের নাম এজাহারে এসেছে। মামলার তদন্তের সময় অভিযোগের সঙ্গে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা আমলে আনা হবে।

দুদকের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে, ইজিপ্টএয়ার থেকে উড়োজাহাজ নিয়ে বিমান সর্বমোট দুই হাজার তিনশত ঊনত্রিশ কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করে। অন্যদিকে উড়োজাহাজ দুটি পরিচালনায় ফ্লাইট অপারেশন ব্যয় হয় এক হাজার তিনশত ঊনচল্লিশ কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেইনটেইন ব্যয় এক হাজার দুইশত পঁয়ষট্টি কোটি টাকা, ফিক্সড ওভারহেড চার্জ চারশত তেইশ কোটি টাকা, সেলস অ্যান্ড সার্ভিস ব্যয় চারশত তেষট্টি কোটি টাকা, নতুন করে ইঞ্জিন লিজের জন্য ব্যয় হয় একশত চুয়াল্লিশ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে খরচ ৩৪৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে এক হাজার একশত একষট্টি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।

জানা গেছে, মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে উড়োজাহাজ দুটি ৫ (পাঁচ) বছরের জন্য লিজ নেওয়া হলেও লিজ গ্রহণের পর মাত্র ১১ মাস পরিচালনা করার পর ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত লিজকৃত উড়োজাহাজ দুটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। উড়োজাহাজগুলো সচল রাখার জন্য ইজিপ্টএয়ার থেকে পুনরায় আরও চারটি ইঞ্জিন লিজ নেওয়া হয় এবং সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়।

বিমান সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার জন্য বিমান কর্তৃপক্ষ উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি মিসরের ইজিপ্টএয়ার থেকে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা আর্থিকভাবে লাভবান হবে কিনা যাচাই-বাছাই করতে বিমানের হিসাব নিয়ন্ত্রক আবু সাইদ মো. মঞ্জুর ইমামকে দায়িত্ব দেয়। কমিটির নির্দেশনা মোতাবেক আবু সাইদ মো. মঞ্জুর ইমাম প্রফিট্যাবিলিটি বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি উপস্থাপন করেন, ইজিপ্টএয়ার থেকে এ দুটি উড়োজাহাজ লিজ নিলে বিমান ৩২ হাজার ৪৪১ ডলার আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

তার তথ্যের ভিত্তিতে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনাফার হিসেবে দেখিয়ে কার্যপত্র তৈরি করে বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করেন এবং অনুমোদন নিয়ে লিজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। হিসাব নিয়ন্ত্রক মঞ্জুর ইমামের প্রফিট্যাবিলিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন—বিমান ৩২ হাজার ৪৪১ ডলার  লাভবান হবে। তবে এই আয় ফ্লাইটপ্রতি, মাসিক কিংবা বাৎসরিক সেই বিষয়টিও প্রতিবেদনে স্পষ্ট করেননি।হিসাব নিয়ন্ত্রকের তথ্যেরভিত্তিতে পরিচালনা পর্ষদ সভায় তৎকালীন সিইও-র উপস্থাপন করা নথির অংশ

কিন্তু পরে দেখা যায় তার এই ফিনান্সিয়াল স্টেটমেন্ট ছিল ভুল, মনগড়া বরং লাভের বদলে ক্ষতি হয়েছে বিমানের। ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

কীসের ভিত্তিতে লাভের তথ্য দিয়েছেন জানতে চাইলে বিমানের হিসাব নিয়ন্ত্রক আবু সাইদ মো. মঞ্জুর ইমাম বলেন, এটি অনেক আগের ঘটনা, আমার এখন বিস্তারিত মনে নেই। প্রফিট্যাবিলিটি প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তবে যতটুকু মনে পড়ে, যেসব রুটে উড়োজাহাজ দুটি পরিচালনা করলে মুনাফা হবে হিসাব করা হয়েছিল পরে আর সেসব রুটে উড়োজাহাজগুলো পরিচালনা হয়নি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শফিউল আজিম বলেন, ইজিপ্টএয়ার থেকে উড়োজাহাজ নিয়ে দুদকের মামলার খবর আমি গণমাধ্যমে জেনেছি। মামলার তথ্য অফিসিয়ালি পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

আরও পড়ুন: