উৎসবের আগে অন্য দেশেও কি পণ্যের দাম বাড়ে?

রমজান সামনে রেখে বাজারে অস্বস্তি বাড়ছে। উদ্বেগ বাড়ছে নিম্নআয়ের মানুষের। রোজার মাস শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে এ দোকান-ও দোকান ঘুরে ঘুরে সাধ্যের মধ্যে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন ক্রেতারা। তাদের কুঁচকানো ভ্রুতে বরাবরের মতো প্রশ্ন— কেবল আমাদের দেশেই কি উৎসবে পণ্যের দাম বাড়ে? নাকি অন্যদেশেও যার যার উৎসবকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে থাকেন? মাত্র দু’-তিন সপ্তাহের ব্যবধানে কি এমন হয় যে, পণ্যের দাম বাড়াতে হয়?

রোজায় ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, ডাল, বেসনের বেশি ব্যবহার হয়। দোকানিরা বলছেন, গত কয়েকদিনে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে। এমনকি শরবত তৈরির জন্য যে ট্যাং লাগে, বাজারে সেটার এখন রীতিমতো সংকট। এদিকে বাজারে গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। মাসখানেক আগে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা দরে, যা এখন ৯৫-১০০ টাকা। ছোলার সঙ্গে ছোলাবুটের দামও বেড়েছে কেজিতে ৫-১০ টাকা। বাজারে প্রতি কেজি ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়।

গত শুক্রবার (১৭ মার্চ) বাজার করে আসা অবসর জীবন কাটানো সি আর রহমান বলেন, ‘আমার পরিবারের বাজার নিয়মিত আমি করি। মুদি ও কাঁচাবাজার থেকেই করি। ফলে আমার চোখে ধরা পড়ে। যারা নিয়মিত বাজার করেন না, তারা এই দাম বাড়ানোর বিষয়টি বুঝবেন না হয়তো। কিন্তু রোজার মাসে আমরা সংযম করবো, এই মাসকে ঘিরে ব্যবসায়ীরা কিছু পণ্যকে  ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যায়। এমনকি উৎসবকে ঘিরে যে কাপড়চোপড় কেনাকাটা— সেখানেও একই জিনিস লক্ষ্য করবেন। কিছু দোকান ছাড় দেয় নানাবিধ, কিন্তু সেগুলো সাধারণের দোকান নয়। অথচ আমার ছেলে আমেরিকায় থাকে। তাদের ওখানে যখন ক্রিসমাস হয়, তখন সেটার কারণে আলাদা করে বাজার অস্থির করার চিন্তা কেউ করে না। বরং বড় বড় ছাড়ের মধ্য দিয়ে উৎসবটা তারা করতে পারে।’

উৎসবে পণ্যের দাম 03

রহমান সাহেবের এই আক্ষেপকে ধরে পার্শ্ববর্তী দেশ ও পশ্চিমের দেশগুলোর পরিস্থিতি জানতে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কলকাতার প্রতিনিধি রক্তিম দাশ জানান, কলকাতায় বিভিন্ন পণ্যের দাম উৎসবে বাড়ে, তবে তা মাত্রাতিরিক্ত নয়। যেমন- ডিমের দাম প্রতি পিস এখন ৬ টাকা শীতকালে, ক্রিসমাসে কেক তৈরির চাহিদা বাড়লে সেটা এক টাকা বাড়ে। এর বেশি নয়। তবে চাল, চিনি, ডাল, তেল, লবণ আলদা করে বাড়ে না। মাংসের দাম কিছুটা বাড়ে। মুরগি পোলট্রির এখন দাম এখন কেজি ২০০ টাকা ওটা বেড়ে হয় ২৫০ টাকা, খাসি ৭৫০ ওটা বেড়ে ৮০০ টাকার মতো হয়। তবে নানা ধরনের ছাড়ও থাকে এবং সরকারের নানা তদারকি থাকে।

বাংলা ট্রিবিউনের লন্ডন প্রতিনিধি মুনজের আহমেদ চৌধুরী জানান, রোজায় ব্রিটে‌নের টেস‌কো আজদা সেইন্সবব্যরীসহ বড় চেইন সুপারশপগু‌লো মুসলমানদের ব্যবহৃত নিত্যপণ্য যেমন- চাল, ছোলা, ভোজ্যতেল, ময়দা, আটা, খেজুর, জুসসহ রোজাদার‌দের খাদ্যপণ্যের জন্য বছরের অন্যান্য নিয়‌মিত সময়ে বি‌ক্রিত মূল্যের চেয়ে মূল্যছাড় দিয়ে বি‌ক্রি ক‌রে। কোনও বছর এর ব্যতিক্রম হয় না। সুপারশপগু‌লো রোজাদার‌দের খাবা‌রের জন্য আলাদা স‌জ্জিত সেকশনও চালু থাকে রোজার মাসে।  ব্রিটে‌নে এ বছর বি‌ভিন্ন অনলাইন শপও রোজাদার‌দের জন্য বিশেষ মূল্যছাড়ে খাদ্যপণ্য হোম ডে‌লিভারি দি‌চ্ছে।

গত ক্রিসমাসের সময় ওয়ালমার্ট ইউএসের প্রধান নির্বাহী গ্রেগ ফরানকে প্রশ্ন করা হয়— বিশ্বমন্দায় কেনাবেচার পরিস্থিতি কেমন। তিনি বলেন, ‘পছন্দের পণ্য কিনতে অনেকেই বিক্রয়কেন্দ্রে আসছেন। বড় ছাড় পাওয়ায় সন্তুষ্ট ক্রেতারা।’ আর নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালিরা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, রোজাকে সামনে রেখে তাদের বাঙালি দোকানগুলোতে নানা ছাড় থাকে।

এদিকে, মার্কিন রীতি অনুযায়ী, থ্যাংকস গিভিং ডে’র পর থেকেই শুরু হয় ক্রিসমাস হলিডে সিজন। মানুষ তাদের পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য বড়দিনের উপহার কিনতে শুরু করে। ১৮৬৯ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। ব্যবসায়ীরা তখন মন্দা থেকে উত্তরণের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ দিনের কথা ভাবছিল, যেদিন বিশাল মূল্য ছাড়ে তারা তাদের পণ্যগুলো বিক্রি করবে। ক্রিসমাসের ছূটি সামনে থাকায় তারা থ্যাংকস গিভিং ডে’র পরের দিনটিকেই এর জন্য বেছে নিয়েছিলেন। এখনও সেই রীতি অব্যাহত আছে। বিশাল ছাড়ে কেনাকাটার উৎসব চলে সেদিন।

উৎসবে পণ্যের দাম 02

পৃথিবীর আর কোনও দেশে উৎসবকেন্দ্রিক দাম বাড়ানোর বিষয়টি আছে কিনা— সন্দেহ প্রকাশ করে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ‘অন্যান্য দেশে ভোক্তাদের ব্যাপারে সরকার সক্রিয়। সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অর্গান সচেতন, সাধারণ মানুষ সচেতন। ফলে কেবল উৎসবকে কেন্দ্র করে দাম বাড়ানোর কথা তারা কল্পনাও করতে পারে না। বাংলাদেশ ঠিক তার উল্টো। এখানে উৎসবকে ব্যবসা-মওসুম মনে করা হয়। ফলে উৎসবকে কেন্দ্র করে বাজার অস্থির করা যাবে না— এমন কথা দায়িত্বশীলরা যখন বলেন, তার আগেই ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন। ফলে তার (দায়িত্বশীলের) বক্তব্যের পরে কেউ দাম বাড়ালো— এমনটা আর প্রমাণ করা যায় না। আমাদের যতগুলো অর্গান আছে, তারা ভোক্তাদের বিষয়ে চরমভাবে বেখেয়াল।’