বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘গ্যাং কালচার’ তৈরির জন্য দায়ী কে?

দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবার পছন্দের শীর্ষে। দীর্ঘ ১২ বছর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা শেষে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আলাদাভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার পর ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে মেলে ভর্তির সুযোগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় শতভাগই নিজ এলাকায় ও পরিবারের কাছে ভদ্র ও মেধাবী হিসেবে পরিচিত। এই শিক্ষার্থীরা পরিবারের গণ্ডি থেকে বাইরে এসে ক্যাম্পাসে যেখানে নিজেকে দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলায় ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে তাদের কেউ কেউ হয়ে ওঠেন সহিংস, মাদকাসক্ত বা ছিনতাইকারী। ২০২৩ সালের শুরুতেই দেশের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায় ছিনতাই, আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবির মতো ঘটনা ঘটেছে।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের তথ্যমতে, ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ) প্রায় শতাধিক ছিনতাই, সহিংসতা, যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। যেগুলো সাংবাদিকদের নজরে এসেছে এবং ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও অন্তরালে রয়েছে আরও অনেক অপরাধ।

চলতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে রয়েছে ২০টি অভিযোগ। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে শতাধিক শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হল পাড়ায়’ এক শিক্ষার্থী তার সহপাঠীকে মারধরের পর বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বেরিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিপথগামী’ শিক্ষার্থীদের রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যার নাম দিয়েছে তারা 'প্রলয় গ্যাং'। এই গ্যাংটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত। রয়েছে আরও দুটি গ্যাং। তাদের একটি ২০১৭-১৮ সেশনের শিক্ষার্থীদের নিয়ে, যার নাম 'নিশাচর' এবং যা বর্তমানে কিছুটা নিষ্ক্রিয় রয়েছে বলে জানা গেছে। অপরটি ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থীদের 'ঐক্যবদ্ধ নিশাচর-২'।

সম্প্রতি প্রলয় গ্যাংয়ের বিষয়টি সামনে আসার পর শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অনেকের মনে এখন প্রশ্ন, এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কারণ কী? বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা ও অপরাধ বিজ্ঞানীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন এবং কীভাবে গড়ে উঠছে এই গ্যাং সংস্কৃতি।

এর জন্য ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী বলে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, গ্যাং কালচার নতুন কিছু না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আদনান রহমতুল্লাহ তূর্য বলেন, গ্যাং কালচার কোনও নতুন ঘটনা না। তবে সাম্প্রতিককালে তা প্রকট আকার ধারণ করার কারণ হলো ক্যাম্পাসের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। একটি দলের একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে সেই দলের ছত্রছায়ায় শুরু হয় ‘নেতা’ হওয়ার দৌড়। সেই দৌড়ে টিকে থাকতে একটি সাধারণত শিক্ষার্থী পরিণত হয় ক্যাডারে।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে নয় বরং ক্ষমতা প্রদর্শন করার মাধ্যমেই যেন নেতা হওয়া যায়। ভালো কাজ নয়, বরং ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে কে কত লোক আনতে পারলো, তা দিয়েই বিচার করা হয় কে হবে পরবর্তী নেতা। ফলে সবাই চায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে। ক্যাম্পাসে ত্রাস সৃষ্টি করে ক্ষমতাধর হতে।

আরেক শিক্ষার্থী রাফিজ খান মনে করেন, ‘ক্যাম্পাসে গ্যাং কালচার সৃষ্টির মূল কারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ক্যাম্পাসে দলবেঁধে মারামারি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধ অহরহ ঘটলেও সেগুলো ফোকাসে না আসা পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে শক্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কেননা, গ্যাং কালচারের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষমতার উৎস ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন। এক্ষেত্রে সংগঠনগুলো নিজেদের ফায়দার জন্য গ্যাং কালচারকে পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে, ক্ষেত্রবিশেষে পদ-পদবি দিয়ে পুরস্কৃতও করে। এই কালচার থেকে ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতারা পেশিশক্তির প্রদর্শন ও আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে কিনা, সেটাও ভাববার বিষয়।’

কী ভাবছে ছাত্র সংগঠনগুলো?
গ্যাং কালচার তৈরির জন্য বর্তমান ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে দায়ী করছে বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। তারা বলছে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিতে এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তবে বিষয়টিকে ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, তারা যেকোনও অপরাধে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। যারা এসব বলছেন তারা ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তাকে ভয় পায় বলে এই ধরনের রাজনৈতিক অভিযোগ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ বলেন, গ্যাং কালচার তৈরির পেছনে সব জায়গাতেই আমরা দেখেছি তাদের পেছনে বিভিন্নভাবে ক্ষমতাসীনরা আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাং কালচারের পেছনেও সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ভূমিকা আছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্যাং আলোচনায় এসেছে তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগও অত্যন্ত স্পষ্ট। শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক তৈরি করে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাং কালচারকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এসব গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারেন না। অন্তরঙ্গতার কারণে বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিভিন্নভাবে এদের টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।

ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম বলেন, ইতোপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাং কালচারের জন্ম হয়নি। ছাত্রলীগের অতীত অপকর্ম, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার আধুনিক রূপ বা প্রক্রিয়া হচ্ছে গ্যাং সংস্কৃতি। এই গ্যাং কালচার ‘প্রলয়’ ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা গঠিত, নেতাদের মদতপুষ্ট একটি সহযোগী সংগঠন, যা একেবারেই স্পষ্ট। এই গ্যাং সংস্কৃতি জন্ম দিয়েছে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া সংগঠন ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগ ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক তানবীর হাসান সৈকত বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাং কালচার তৈরি হওয়ার ইতিহাস নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ছাত্রলীগ ও সাংবাদিকদের অগোচরে একটা গ্যাং তৈরি হওয়ার পথে ছিল। তবে একে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমরা কখনও দেখিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পানির ব্যবসা করতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সেন্টারকে কার্যালয় হিসেবে ঘোষণা করতে। এগুলো আমরা আগে কখনও দেখিনি। কেন যে এই ধরনের উগ্রবাদী মানসিকতা তৈরি হয়েছে?  ভবিষ্যতে এসব আর কেউ যেন না করতে পারে সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আহ্বান জানাই, আমরা ছাত্রনেতারাও সহযোগিতা করবো। সাংবাদিকদেরও আহ্বান জানাই এরকম কিছু দেখলে দৃষ্টিগোচর করতে।

বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর ছাত্রলীগকে দায়ী করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাদের কেন পৃষ্ঠপোষকতা করবো? ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের আমরা কেউ চিনি না। আর তাদের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত থাকারও সুযোগ নেই। তারা বিষয়টি রাজনৈতিককরণের জন্য এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। ছাত্রলীগ এসব কর্মকাণ্ডে জিরো টলারেন্স নীতি মেনে চলে। গত তিন মাসে ক্যাম্পাসে যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে তাতে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল, যা প্রক্টরকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। তারা সে অনুযায়ী পদক্ষেপও নিচ্ছে। যারা ছাত্রলীগকে দায়ী করছে, শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কম।

ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তাকে ভয় পায় বলেই তারা এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।

কী বলছেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা?

অপরাধ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, এই ধরনের কার্যক্রমে কোনও ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ইয়াং জেনারেশনের মাঝে অস্থিরতা এবং তাদের এই ধরনের সহিংস মনোভাব আধুনিকায়নের এক ধরনের সিম্পটম। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গায় গ্যাং কালচার তৈরি হচ্ছে। আমরা যদি এগুলো শক্তভাবে দমন না করি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো কোনোভাবেই কাম্য না। এখানে আসা শিক্ষার্থীরা অনেক প্রতিযোগিতা করে আসে। তারা প্রত্যেকেই মেধাবী। বিশেষ করে ভুক্তভোগীরা ভালোভাবে বোঝেন এই বিষয়টা কত খারাপ।

বিষয়টি দমনের পরামর্শ দিয়ে এই অপরাধবিজ্ঞানী বলেন, আমাদের দেশে যেহেতু রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখনও ঠিকভাবে উন্নত হয়নি, ফলে এই ধরনের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে। আর এজন্য ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনে সংশ্লিষ্ট কেউ থাকলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে কেউ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব কাজ করতে না পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রক্টরিয়াল টিমকে ঢেলে সাজানো উচিত।

এছাড়াও তিনি ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক পরিবেশ উন্নয়নের পরামর্শ দেন, যাতে শিক্ষার্থীরা সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে না পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর পরিবেশ উন্নত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, হলগুলোর পরিবেশ আসলেই স্বাস্থ্যকর না। পরিবেশ উন্নত করে তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া উচিত। এছাড়াও শিক্ষার্থী যারা এসবে জড়াচ্ছে তাদের হয়তো দারিদ্র্য সমস্যা থাকতে পারে। পড়ালেখার জন্য তার টাকার প্রয়োজন হতে পারে। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে কাজ করা উচিত।