ঈদের দিন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে চান সবাই। তাই ছুটিতে দূরদূরান্ত থেকে বাড়ি ফেরেন সবাই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বিদেশে থাকা প্রবাসীরা। চাইলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সুযোগ হয় না তাদের। প্রবাসে বসে নিজেরা সাদামাটা ঈদ কাটালেও পরিবারের ঈদ রঙিন করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন এবং দেশে রেমিট্যান্স পাঠান।
অনেকে আবার কায়দা-কানুন করে ছুটি নিয়ে আসেন দেশে। তাদের মধ্যেও অনেকের ভাগ্যে থাকে না পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর। ছুটি বেশি না থাকায় বা যাত্রার তারিখ ঠিক রাখতে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে জীবিকার তাগিদে ফিরে যান প্রবাসে, কর্মক্ষেত্রে।
শনিবার (২২ এপ্রিল) বাংলাদেশে ঈদের দিন। দেশজুড়ে ঈদ উৎযাপন করেছেন মুসলমানরা। এদিনও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৫৪টি ফ্লাইট বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যাত্রীদের নিয়ে গেছে। এসব ফ্লাইটে কেউ ঘুরতে, কেউ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে কিংবা চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন।
তবে অবাক বিষয় হলো, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যাত্রী ছিলেন প্রবাসীশ্রমিক। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্লাইটে বেশির ভাগ যাত্রীই প্রবাসী কর্মী। নির্মম বাস্তবতায় ঈদের দিনেও দেশ ছেড়ে যেতে হয়েছে তাদের।
পরিবারকে সুখে রাখতেই প্রবাসীদের প্রচেষ্টা নিরন্তন। পরিবারের অভাব ঘোচাতে বিদেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তারা। নিজের সুখ বিলিয়ে দিয়ে প্রিয়জনের সুখের খবর শুনেই কাটে তাদের প্রবাসজীবন।
প্রবাসী শ্রমিকরা শুধু পরিবারকেই সুখে রাখেন না। তারা আদতে দেশের সেবাও করে যাচ্ছেন নিয়মিত। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে চাঙা হয় দেশের অর্থনীতি। এবার রমজানের শুরু থেকেই প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা।
জানা যায়, গত ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংকিং চ্যানেলে ৯৫ কোটি ৮৭ লাখ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে) যার পরিমাণ ১০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। হতাশার বিষয় হলো, তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন দেশে এলেও আসতে পারেন না হাড়ভাঙা খাটুনি করা এসব প্রবাসী।
২১ বছর ধরে সৌদি আরবে জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন মো. আবুল খায়ের। ২১ বছরে ছয়-সাতবার দেশে এসেছেন। তবে কখনও ঈদের সময় দেশে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি তার। এবার আশা করেছিলেন ঈদের দিন কাটবে স্বজনদের সঙ্গে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যে সেই সুযোগ মেলেনি। ঈদের দিনে রাতে তার ফিরতে হবে সৌদি আরবে। তাই দুপুরেই কুমিল্লা থেকে চলে এসেছেন বিমানবন্দরে।
জীবনের নানা প্রসঙ্গ বলতে বলতে চোখ ছলছল করে ওঠে আবুল খায়েরের। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমরা প্রবাসীদের জীবনটাই এমন। চাইলেও পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার সুযোগ হয় না। কতবার দেশে আসলাম, কখনও ঈদে দেশে থাকা হয়নি। ২১ বছরের প্রবাসজীবনে এই প্রথম ঈদের দিনে দেশে। সকালে সবার সঙ্গে সময় কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি থেকে চলে আসছি। আমরা রাতে ফ্লাইট, সৌদি আরবে ফিরে যাবো।
তিনি আরও বলেন, আমি যার অধীনে কাজ করি, তিনি আগে একবার টিকিট করে দিয়েছিলেন, কিন্তু ফ্লাইট সংক্রান্ত জটিলতায় যাওয়া হয়নি। ভেবেছিলাম তাহলে ঈদের পরেই যাবো। কিন্তু আবার যখন ফ্লাইটের টিকিট পেলাম, তখন দেখি ঈদের দিনেই ফ্লাইট।
মো. আবুল খায়ের বলেন, আমার বৃদ্ধ মাকে বাড়িতে রেখে চলে আসছি। এটা যে কেমন কষ্ট, ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। আমার পাড়া-প্রতিবেশীরাও বলেছে থেকে যেতে, কিন্তু আমি নিরুপায়।
বিমানবন্দরে মোবাইলে দেড় বছরের সন্তানের ছবি দেখছিলেন প্রবাসী আরিফ মৃধা। সন্তান হওয়ায় জীবন অনেক রঙিন হয়ে ওঠে আরিফের। কিন্তু সেই সন্তানকে বাড়িতে রেখে ঈদের দিনেও তাকে ফিরে যেতে হচ্ছে সিঙ্গাপুরে।
আরিফ মৃধা বলেন, সিঙ্গাপুরে যে কোম্পানিতে কাজ করি, তারা আজকের তারিখে টিকিট করে দিয়েছে। ইচ্ছা না থাকলেও কিছু করার নেই। ছেলেটাকে বাড়িতে রেখে চলে আসছি। আসার পর থেকেই ও (ছেলে) কান্না করছে, চারদিকে তাকিয়ে আমাকে খোঁজে। তার মা শান্ত করতে পারছে না। তাই ভিডিও কলে ছেলের সঙ্গে কথা বলছি।
একই রকমভাবে ঈদের দিন দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন প্রবাসী দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, আমার কোম্পানিকে বারবার বলেছিলাম ঈদের দিনে ফ্লাইট না দিতে। কিন্তু হঠাৎ দেখি ২২ এপ্রিল ফিরতি ফ্লাইট। আশা ছিল ঈদে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আনন্দ করবো। কিন্তু ভাগ্যে নেই, কী করবো।
তিনি আরও বলেন, ঈদের দিন চলে আসছি বাড়ি থেকে। সবাই মন খারাপ করছে, কান্নাকাটি করছে। প্রবাসজীবনের এসব কষ্টই আমাদের জীবন।