বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি

যে কারণে ৫৮ মামলায় আসামি হলেন আবদুল হাই বাচ্চু

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ৫৯টি মামলা হয়েছে। ২০১৫ সালে এসব মামলা দায়ের করা হলেও কোনও মামলার এজাহারেই আসামি হিসেবে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। যদিও এসব ঋণ কেলেঙ্কারির মূল কারিগর হিসেবে সবার আঙুল ছিল তার দিকে। এ নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনাও কম হয়নি। তবে তদন্ত শেষে দীর্ঘ ৮ বছর পর এই ৫৯টি মামলার মধ্যে ৫৮টির চার্জশিটেই আসামি হিসেবে বাচ্চুর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

সোমবার (১২ জুন) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে ৫৯টি মামলার চার্জশিটের অনুমোদন দিয়ে আদালতে দাখিল করার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, বেসিক ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির মূল হোতা হিসেবে আসামি করা হয় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে। এর কারণ হচ্ছে, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের হওয়া ৫৯টি মামলার মধ্যে ৫৮টিতেই তাকে প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে দায়ী করে আসামি করার জন্য সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এতে কিছুটা বিপাকে পড়েন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শীর্ষ কর্মকর্তারা। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে— শুধুমাত্র ৪১ নম্বর মামলা অর্থাৎ গুলশান থানার একটি মামলার চার্জশিটে তাকে অভিযুক্ত করা হয়নি। এর কারণ হলো— ওই ঋণ সংক্রান্ত কোনও কাগজপত্র বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়নি। সংশ্লিষ্ট শাখা থেকেই সেই ঋণ কেলেঙ্কারি করা হয়েছিল। আর বাকি ৫৮টি ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটনার কাগজপত্র বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন পেয়েছিল। তাই দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের সুপারিশ অনুযায়ী কমিশন আবদুল হাই বাচ্চুকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিতে অনুমোদন দেয়।

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর তদন্ত করেন দুদকের পাঁচ জন কর্মকর্তা। দুদকের পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম ৬টি, উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ১৫টি, উপ-পরিচালক  মো. মোনায়েম হোসেন ১৭টি, উপ-পরিচালক মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান ১৮টি এবং মোহাম্মদ সিরাজুল হক তিনটি মামলার তদন্ত করেন। সোমবার (১২ জুন) এসব তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন বলে জানিয়েছেন দুদকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

৫৯টি ঋণ কেলেঙ্কারি মামলায় আবদুল হাই বাচ্চুসহ আসামি করা হয়েছে ১৪৭ জনকে। দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, স্বাধীন কমিশন হিসেবে তারা স্বাধীনভাবেই তদন্ত করেছেন। তদন্ত শেষে এসব মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিলের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু, সাবেক কোম্পানি সচিব শাহ আলম ভুঁইয়া এবং এসডি সার্ভে ফার্মের ম্যানেজিং পার্টনার ইকবাল হোসেন ভুঁইয়ার নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

এজাহারে কেন তাদের আসামি করা হয়নি প্রশ্নে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এজাহারে নাম আসুক আর না আসুক, তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। সেজন্য তাদের নাম চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’

দুদক সচিব আরও বলেন, ‘বেসিক ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীসহ এজাহারনামীয় এবং তদন্তে শনাক্ত আসামিরা অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তারা বিশ্বাস ভঙ্গ করে অন্যায়ভাবে নিজেরা লাভবান হয়ে এবং অন্যকে লাভবান করে ভুয়া মর্টগেজ, মর্টগেজের অতিমূল্যায়ন এবং মর্টগেজ ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বেসিক ব্যাংক লিমিটেড থেকে ঋণ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দুদকের  তদন্তে এমন তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।’

আসামি করা হয়নি পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের

বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের আসামি না করার কারণ হিসেবে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বোর্ড সভার নির্ধারিত তারিখের সাত দিন আগে নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে নোটিশ দেওয়া হয়েছে বোর্ড মিটিংয়ের আগের রাতে বা মিটিংয়ের দিন সকালে। বোর্ড সদস্যদের শুধু হাজিরা শিটে সই থাকতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিটিংয়ের  এজেন্ডা থাকতো শতাধিক। কিন্তু মিটিংয়ের সময় থাকতো অল্প। স্বল্পতম সময়ে তাড়াহুড়ো করে সভা পরিচালনা করা হতো।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন ব্যাংকের বোর্ড রেজুলেশনে পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যের সই থাকে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের বোর্ড রেজুলেশনে চেয়ারম্যান, কোম্পানি সচিব ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সই থাকতো। বোর্ড সভার রেজুলেশন পরবর্তী সভায়  অনুমোদনের জন্য বোর্ড সদস্যের কাছে উপস্থাপনও করা হয়নি। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের রেজুলেশনে বোর্ড সদস্যদের কোনও সই নাই। এটা অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। যাতে কু-ঋণ নিতে অন্যান্য পরিচালকের সই নিতে না হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রেকর্ডপত্রের অপূর্ণতা থাকতো। তা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান নিজে তা ঠিক করে নেবেন বলে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যকে আশ্বস্ত করা হতো। এভাবে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। যে কারণে ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে অন্যান্য বোর্ড সদস্যকে আসামি করা হয়নি।