সড়কে ‘ঘাতক’ ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা জানে না কেউ

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ইঞ্জিনচালিত গণপরিবহনের প্রকৃত সংখ্যা কত? সড়কে চলাচল করা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যাই বা কত? সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের আসল সংখ্যা কত? এসব প্রশ্নের উত্তর নেই সরকারি-বেসরকারি কোনও সংস্থা বা সংগঠনের কাছে। এই তিন ক্ষেত্রে একটি অপরটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও মিলছে না সঠিক তথ্য। কয়েকটি সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের মাস ও বছরভিত্তিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করলেও তথ্য বিভ্রাট লক্ষ্যণীয়। এর দায় নিচ্ছে না কেউ!

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে কী পরিমাণ গণপরিবহন চলাচল করছে এবং তার মধ্যে বৈধ ও অবৈধ যানবাহনের সঠিক তথ্য থাকাটা সবচেয়ে জরুরি। কারণ গত এক দশকে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যাও বেড়েছে। এর বাইরেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— সড়ক দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অবৈধ বা ফিটনেসবিহীন গণপরিবহনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল। অধিকাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই গাড়িটির হয় ফিটনেস ছিল না, কিংবা সড়কে চলাচলের উপযুক্ত ছিল না। চালকের অদক্ষতার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, সেটি ভিন্ন কথা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে বেসরকারি সংগঠনগুলো কাজ করায় আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সচেতনতা বেড়েছে। এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান নিমমিত প্রকাশ করার বিষয়টি। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী অবৈধ বা ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ে কেউ সেভাবে কাজ করছে না। ফলে এ ক্ষেত্রে তেমন কোনও তথ্যই মিলছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রে তথ্য বিভ্রান্তির দায় মূলত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। বেসরকারি সংগঠনগুলোর দায়ের চেয়ে সীমাবদ্ধতা বেশি বিদ্যমান।

সড়কে প্রায়শই দেখা মেলে এমন ভাঙাচোড়া গাড়ি

ফিসনেসবিহীন গাড়ির সঠিক তথ্য নেই

চলতি বছরের ১ জুন বিআরটিএ’র ওয়েবসাইটে হালনাগাদ করা তথ্য অনুযায়ী, মে মাস পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৩টি। যা ২০১০ সালে ছিল ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি। ফলে গত এক যুগে (২০১০-২০২২) নিবন্ধিত যানবাহন বেড়েছে ৪৩ রাখ ১৪ হাজার ৪৯৫টি। এর মধ্যে ৫-৬ লাখের বেশি গাড়ি ফিটনেসবিহীন বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফিটনেস পরীক্ষা না করায় এবং নানান কায়দায় এসব গাড়ি নিবন্ধিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্রমতে, নিবন্ধিত যানবাহনের বাইরেও সড়কে চলাচল করা গাড়ির মধ্যে একটি বড় অংশই ফিটনেসবিহীন ও চলাচলের অনুপযোগী। অনিবন্ধিত এই যানবাহনের সংখ্যা কত, সেই তথ্য বিআরটিএ’র কাছে নেই। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ির পরিমাণ কত সে তথ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন, ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার ২৯টি। মালিকদের এসএমএস-এর মাধ্যমে ফিটনেস করার তাগাদা, সার্কেল অফিস থেকে নবায়নের ব্যবস্থার পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড ও ডাম্পিংসহ নানামুখী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি

ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে রঙ করে আবার নামানো হয় সড়কে

ফিটনেস সনদ হালনাগাদের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নিয়মিত করছেন না বাস মালিকরা। এর ধারণা মেলে ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে জমা দেওয়া এক জরিপ প্রতিবেদনে। আদালতের নির্দেশে গঠিত একটি জাতীয় নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ কমিটি সে সময় জানায়, ৮৩টি যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেস নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এর ফলাফলে দেখা যায়, ২৪ শতাংশ যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট সঠিক নেই অথবা গ্রহণযোগ্য নয়। ফিটনেস সার্টিফিকেট নেই ৩৩ শতাংশ বাসের, ৫৬ শতাংশের স্পিড গভর্নর সিল নেই।

সড়ক দুর্ঘটনায় অন্যতম দায়ী ফিটনেসবিহীন গাড়ি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের এক হিসাব বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার অন্যান্য কারণের মধ্যে ৬৬ হাজার ৬৬১টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন দায়ী। আরেক হিসাব অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দুর্ঘটনার জন্য ১১ হাজার ৯২৯টি যানবাহন দায়ী। এরমধ্যে ফিট গাড়ির সংখ্যা ৮ হাজার ১৮টি, আনফিট গাড়ি ২ হাজার ৪৪৫টি এবং অন্যান্য ১ হাজার ৪৬৬টি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিআরটিএ অনেকবার জরিমানা ছাড়াই ফিটনেস সনদ হালনাগাদের সুযোগ দিলেও তেমন সাড়া দিচ্ছেন না মালিকরা। ফিটনেস সনদ ছাড়াই চলাচলের অনুপযোগী গাড়ি সংশ্লিষ্টদের বিভিন্নভাবে ম্যানেজ করে চালানোর চেষ্টা করেন তারা। এতে আনফিট বা ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনাও বাড়বে।

তার মতে, ফিটনেস পরীক্ষার প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে করা না গেলে যানবাহনের কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটলে সেটি দুর্ঘটনা বলা যাবে কিনা তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। এটির একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে আমলে নেওয়া উচিত। আইনের প্রয়োগটা যথাযথভাবে করতে হবে বিআরটিএকে। অভিযান আরও জোরদার করতে হবে। সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হবে। মৃত্যুর মিছিল থামাতে এর বিকল্প নেই।

ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে রঙ করে আবার নামানো হয় সড়কে

সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয় গাড়ির ফিটনেস ছিল না। চালকের লাইসেন্স ছিল না। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে সড়ক পরিবহন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। একটি অসাধু চক্রের কারণে আইনের এমনটি হচ্ছে, যাতে যত নৈরাজ্য থাকবে, তত চাঁদাবাজি করা যায়। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত দুর্ঘটনা ঘটছে, যা প্রাণহানি না বলে হত্যাকাণ্ড বলা উচিত।

বুয়েটের একটি সূত্র বলছে, ইঞ্জিনচালিত ভেহিক্যালের মধ্যে নিবন্ধিত মোটরসাইকেল রয়েছে ৩৫ লাখের বেশি। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া রয়েছে আরও ১৫ লাখের মতো। ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যাটা ৪০-৫০ লাখের কাছাকাছি এবং স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি নসিমন-করিমনের মতো গাড়ির সংখ্যাও ১০ লাখের মতো হতে পারে। এসব যানবাহনের মধ্যে বেশিরভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফিটনেস সনদ থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, এক লাখ ১০ হাজারের মতো বাস, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের সংখ্যা ৪ লাখের কাছাকাছি হবে। পিকআপের সংখ্যা ৭ থেকে ৮ লাখের মতো। এরমধ্যে ফিটনেসবিহীন বাস ২০ শতাংশ, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ২০-২৫ শতাংশ, পিকআপের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ হতে পারে। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত হিউম্যান হলারের ৮০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন। ৪০ লাখের মতো মোটররিকশাকে আনফিট বলা যায়।

ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোকে রঙ করে আবার নামানো হয় সড়কে

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চাঁদাবাজি, অনৈতিক অর্থ লেনদেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কারণে সড়কে আনফিট গাড়ি চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। পদে পদে পুলিশের হয়রানিও একটি বড় বাধা। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্বে থাকা মহলকে ম্যানেজ করে চলেন মালিকরা। ভ্রাম্যমাণ আদালত যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিচালনা না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে সড়ক-মহাসড়কে প্রাণহানি ঘটছে।

বিআরটিএ’র ভাষ্য

বিআরটিএ’র সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সড়ক-মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধের তারা সারা বছরই তৎপর থাকেন। নিয়মিত অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে পরিবহন মালিকদের কারণেই মূলত ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমছে না, বরং বাড়ছে।

রাজধানীর বিভিন্ন গ্যারেজে এমন ফিটনেসবিহীন গাড়ির মেরামত

অভিযোগ আছে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, রুট ভায়োলেশন/রুট পারমিটবিহীন, ফিটনেসবিহীন, হাইড্রোলিক হর্নসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ে বিআরটিএ অভিযানে নামলেই বেঁকে বসেন যানবাহন মালিকরা। বিশেষ করে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলেই হঠাৎ সড়কে বাস নামানো কমিয়ে দেন তারা। সেই সঙ্গে বিআরটিএ’র অভিযানের কার্যকারিতা নিয়েও নানা অভিযোগ করতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (রোড সেফটি) মাহবুব-ই-রব্বানী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কোনও পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। নতুন আইন অনুযায়ী নিয়মিত অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হয়। আমরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে কাজ করে যাচ্ছি, বসে নেই।

বিআরটিএ সক্রিয় থাকার পরও সড়কে এত ফিটনেসবিহীন যানবাহন কীভাবে চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি দেখার প্রধান দায়িত্ব পুলিশের। তাদের লোকবলও আছে। তাদের জিজ্ঞাসা করেন কীভাবে এসব গাড়ি সড়কে নামছে। আমরা তো অভিযান চালাচ্ছিই। আর কী করতে পারি?

ভাঙাচোড়া গাড়িকে রঙ করে নামানো হয় সড়কে

যা বলছে পুলিশ

রমনা ট্রাফিক বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার জয়দেব চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেয় বিআরটিএ। এটি তো আর আমরা দেই না। আমরা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে অভিযান চালিয়ে থাকি। সনদ ছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি পেলে ডাম্পিং করা হয়, মামলা দেওয়া হয়।