পণ্য পরিবহনে কদর হারাচ্ছে নৌপথ

একসময় দেশের ভেতরে যোগাযোগের প্রধান ব্যবস্থা ছিল নদীপথ। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে নৌপথই ছিল মানুষের নির্ভরতার নাম। সময়ের সঙ্গে সেই নির্ভরতার জায়গা দখলে নিয়েছে সড়ক পথ। যাত্রী পরিবহনে এখনও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে নৌপথ ব্যবহারের কদর আছে। তবে পণ্য পরিবহনে নৌপথ অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

রাজধানীর প্রধান নদীবন্দর সদরঘাটের পার্শ্ববর্তী শ্যামবাজার, বাদামতলি, সোয়ারিঘাটে পণ্য নিয়ে আসা নৌকা ও ট্রলারের শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে হতাশার গল্পই। তাদের মতে, ২০ বছর আগেও নদীপথে পণ্য পরিবহনে রমরমা অবস্থা ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জৌলুস হারিয়েছে নৌপথে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা। বর্তমানে মূলত নদীকেন্দ্রিক বাজারগুলোতে নৌপথে মালামাল পরিবহন করা হয়। তবে তার প্রায় শতভাগই কৃষিপণ্য। মূলত প্রান্তিক যেসব এলাকায় সড়কপথে এখনও যোগাযোগ সুবিধা উন্নত হয়নি, সেসব এলাকা থেকে মালামাল পরিবহনে নৌপথের ব্যবহার হয়।

এছাড়াও বাল্কহেড ব্যবহার করা হয় বালু পরিবহনের কাজে। নদীবন্দর কেন্দ্রিক এলাকা অর্থাৎ লঞ্চ যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে এমন এলাকাগুলোতে মালামাল পাঠানো হয়। এর বাইরে পণ্য পরিবহনে শতভাগ নির্ভরতা সড়ক পথের ওপর। দেশের সড়ক পরিবহনে আরও উন্নতি সাধন হলে নৌপথের চাহিদা শূন্যের কোঠায় পৌঁছাবে বলেও মনে করেন তারা।

লঞ্চে যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে এমন এলাকাগুলোতে মালামাল পাঠানো হয় নৌপথে

শ্যামবাজার ঘাটের নৌকার মাঝি কলিম মিয়া (৫৫) বলেন, ‘জোয়ান বয়স থেকেই এই ঘাটে নৌকা চালাই। আমার বাপেও এ ঘাটে নৌকা চালাতো। এই শ্যামবাজার ঘাটে আগে যে পরিমাণ মাল নৌকায় আসতো এখন তো আগের মতো আসে না। আমরাও বড় নৌকায় আলু, পেঁয়াজ নিয়ে বিভিন্ন ঘাটে গেছি। চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল, খুলনা থেকে নৌকায় মাল আসা দেখছি। এখন তো আর সেই অবস্থা নাই। সব ট্রাক, পিকআপে আসে।’

ফরিদপুর থেকে ট্রলারে মাল নিয়ে আসা রাসেল বলেন, 'সপ্তাহে একদিন আসি। যে যা দেয় আলু, পেঁয়াজ, কাঁচা তরকারি, লোহা, কাপড় সব আনি। সব মালই ট্রাকে আসে ফরিদপুর থেকে। যার যেটা এড়িয়ে যায় আমার ট্রলারে তুলে দেয়। যাওয়ার সময় এখান থেকে যাদের অর্ডার আছে মাল নিয়ে যাই। এভাবে তো পেট চলে না আমার। কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়।'

তবে ঠিক কী কারণে নৌপথে পণ্য পরিবহনে আগ্রহ কমছে—এর উত্তরে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নৌপথে সুবিধার থেকে সড়ক পথের সুবিধা বহুগুণে বেশি। বরং নৌপথে মালামাল আনা-নেওয়া করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

খরচ কম হলেও নৌপথে সময় বেশি লাগে, এজন্য ব্যবসায়ীরা সড়কপথই বেছে নেন

এই উত্তরের পক্ষে তাদের যুক্তি, সময়ের সঙ্গে নৌকাগুলোতে ইঞ্জিন বসে ট্রলার হয়েছে, এতে গতি বেড়ে সময় বাঁচলেও সড়ক পথের চেয়ে দ্রুত পৌঁছানো যায় না। নৌপথে খরচ সড়কপথের চেয়ে সামান্য কম। কিন্তু বিপরীতে সময় বেশি লাগে। এছাড়াও সড়কপথে যেখানে খুশি মালামাল নামানো যায়। কিন্তু নৌপথে ঘাটে ট্রলার আসার পর পণ্য ট্রলার থেকে সড়কে নেওয়া, সেখান থেকে প্রয়োজনে ভ্যান বা রিকশায় নিতে হয় গন্তব্যে পৌঁছাতে। এছাড়াও সব ধরনের মালামাল নৌপথে নেওয়াও সম্ভব না। ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথের সীমাবদ্ধতা এখন কৃষিপণ্য আর বালু বহনে।

মুন্সীগঞ্জ থেকে চালকুমড়া নিয়ে শ্যামবাজার আসেন শরীফ খান। তিনি বলেন, 'আমার নিজের ট্রলার, সারা বছরই ঢাকায় মাল আনি। ধরেন ট্রলারে চার হাজার চালকুমড়া এনেছি, ট্রাকে আনলে ১০০০ মাল আনা যায়। আমার প্রায় ৮০০০ টাকা তেল খরচ দিয়ে ট্রাকে ৯০০০ পড়তো। কিন্তু ট্রলারে আসতে ৪-৫ ঘণ্টা লাগে, সেখানে ট্রাকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যেতাম।’

সোয়ারিঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী কালাম শেখ বলেন, ‘এখন তো পিকআপেই মাছ আসে ড্রামে করে। পিকআপ আড়তের সামনে দাঁড়ায়, মাল নিয়ে নিই। আড়তের সামনে থেকেই পিকআপ লোড করি। নদী দিয়ে আনলে ঘাটে আসবে, সেখান থেকে দোকানে আনা খরচ বেশি হয়। দৌড়াদৌড়ি, ট্রলারের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।'

ট্রলার ও নৌকা চালকরা জানান, মূলত নিয়মিত সবজি-তরকারির বাইরে সিজনাল ফলের চাহিদা বেশি। বিশেষ করে আম, কাঁঠাল, তরমুজ, লিচু আনতে নৌপথের ব্যবহার বেশি।

দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক পথে যোগাযোগ শুরু হওয়ার আগে শতভাগ পণ্যই প্রায় লঞ্চে আনা-নেওয়া হতো

চাঁদপুর থেকে সদরঘাট খেয়াঘাটে আসা মামুন শিকদার নামের এক ট্রলার মালিক বলেন, 'ট্রলারে মূলত সিজনাল ফল নিয়ে আসি। বাদামতলি বাজারে এখন আম নিয়ে এসেছি। যাওয়ার সময় মাল্টা নিয়ে যাবো। এমনিতে তো চাহিদা নেই ট্রলারের, আমি নিজের জন্যই ট্রলার ব্যবহার করি।'

শ্যামবাজারের সরকার বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. সাইদ বলেন, ‘ভোরে নৌপথে শাকসবজি আসে শাপেরচর, ধামরাই, সাভার এসব এলাকা থেকে। আলু, পেঁয়াজসহ অন্যান্য পাকামাল ট্রাকে আসে। '

পান ব্যবসায়ী প্রাণকৃষ্ণ দেব বলেন, ‘বরিশাল এলাকা থেকে লঞ্চে পান আসে, আর সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ থেকে ট্রাকে আসে। যেখানে যেমন ব্যবস্থা সেভাবে পণ্য আসে।'

দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক পথে যোগাযোগ শুরু হওয়ার আগে শতভাগ পণ্যই প্রায় লঞ্চে আনা-নেওয়া হতো। কিন্তু সড়ক যোগাযোগ শুরু হওয়ায় সেখানেও পড়েছে ভাটা।

লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বলেন, 'আগে যেখানে প্রতিদিন ২০-৩০ টন মাল লঞ্চে শুধু বরিশালেই গেছে, সেটা এখন ১৫-২০ টনে এসে ঠেকেছে। সামনে আরও কমবে বলে শঙ্কা আমাদের।’

ছবি: প্রতিবেদক।