জনস্বার্থবিরোধী কাজ ঠেকাতে যা করে দুদক

জনস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড তথা দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করে। কখনও ফাঁদ পেতে আবার কখনও হটলাইনে অভিযোগ পেয়ে দুদক কর্মকর্তারা অভিযান চালান বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে। স্থানীয় সরকার ও নাগরিক-সেবা, ভূমি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন, বন ও পরিবেশ, পরিষেবা, প্রকৌশল, কৃষি ও অর্থসহ প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই বিভিন্ন সময় অভিযান চালান তারা। এছাড়া তফসিলবহির্ভূত জনগুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে।  

এনফোর্সমেন্ট ইউনিট

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতিবাজদের মনে ভীতি তৈরি করতেই মূলত এই এনফোর্সমেন্ট ইউনিট গঠন করা হয় ২০১৯ সালে। একজন উপ-পরিচালক, দুই জন সহকারী পরিচালক, চার জন উপ-সহকারী পরিচালকসহ মোট ২৬ জন জনবল নিয়ে এ ইউনিটের কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। অভিযোগের অনুসন্ধান, তদন্ত, দুর্নীতির প্রতিরোধমূলক কাজ ও এনফোর্সমেন্ট অভিযানসহ বিভিন্ন কাজ রয়েছে এই ইউনিটের। অভিযানের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে উপ-পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বরাবর একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে হয় সংশ্লিষ্টদের। টিমের প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী এনফোর্সমেন্ট ইউনিট কমিশনের অনুমোদন নিয়ে মামলা দায়েরের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরকে চিঠি দিয়ে থাকে। ‘দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪’-এর ১৭(ট) ধারা অনুযায়ী এনফোর্সমেন্ট ইউনিট এসব কাজ করে থাকে।

এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের দুই সদস্যহটলাইন ১০৬

ঘুষ, অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থপাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি সম্পদ ও অর্থ-আত্মসাতের অভিযোগ জানাতে দুদকে রয়েছে টোলফ্রি হটলাইন। যেকোনও নম্বর থেকে যেকোনও সময় ১০৬ নম্বরে কল করে অভিযোগ জানানো যায়। বিভিন্ন সরকারি দফতর ও ওয়েবসাইটে এই নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে ভুক্তভোগী তার অভিযোগ সহজেই জানাতে পারে। এই হটলাইনের দেখভালের দায়িত্ব এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের। যাতে তারা অভিযোগ পেয়েই প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক অভিযান কিংবা পদক্ষেপ নিতে পারে।

দুদকের হটলাইনে প্রতিদিনই বিভিন্ন অভিযোগ জানিয়ে কল আসে। এরমধ্যে বেশিরভাগই দুদকের তফসিলবহির্ভূত। ২০২২ সালে দুদকে কল এসেছে ৩৯ হাজার ৪৮৮টি। এরমধ্যে দাফতরিকভাবে রেকর্ড করা হয় মাত্র এক হাজার ৭৬২টি। এছাড়া দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল থেকে নেওয়া হয় ১৪৮টি অভিযোগ। ই-মেইল ও সোশ্যাল মিডিয়া সোর্স থেকে ৭৭ অভিযোগ এবং প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়া থেকে ৫৬৩ অভিযোগসহ দুই হাজার ৫৫০ অভিযোগের বিষয়ে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ছয় মাসে দুদকের হটলাইন ও অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া ৬২৯টি অভিযোগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে এনফোর্সমেন্ট ইউনিট। এরমধ্যে অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন দফতরে ১৮৫টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। দুদক আইনে তফসিলবহির্ভূত হওয়ায় ১১২টি অভিযোগ সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন অভিযোগে অভিযান চালানো হয় ২৮৬টি। অভিযান শেষে জরিমানা, কারাদণ্ড ও ঘুষের টাকা উদ্ধারসহ নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এছাড়া অভিযানের পর কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ২৮টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়—এগুলো বর্তমানে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানের তালিকায় রয়েছে।

২০২২ সালে এনফোর্সমেন্ট অভিযানের পর শাস্তিমূলক বদলি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয় ১০ জনের বিরুদ্ধে। কারাদণ্ড দেওয়া হয় ১৩ জনকে। বরখাস্ত করা হয় সাত জনকে। কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয় তিন জনকে। অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ ব্যবহার, ইটভাটা পরিচালনা, বালু উত্তোলন, সরকারি জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে জরিমানা আদায় করা হয় ৫ লাখ ১৩ হাজার ৯০০ টাকা। আত্মসাৎকৃত সরকারি অর্থ আদায় করা হয় এক কোটি ১২ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৭ টাকা। ঘুষের অর্থ উদ্ধার করা হয় ৯৬ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রদানে দুর্নীতি উদঘাটন করা হয় ৫ লাখ ২ হাজার ৫৯২ টাকার। কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পের দুর্নীতি উদঘাটন করা হয় ৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকার।

দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুদকের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের অভিযান ও অন্যান্য কার্যক্রম ইতোমধ্যে জোরদার করা হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে কিছু দিনের জন্য সব কার্যক্রমই কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। পরে এনফোর্সমেন্ট বলেন, আর  ট্র্যাপ কেস বলেন, সেগুলো প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যেটা করা দরকার, সেটা চলমান আছে।’

অভিযুক্তদের জন্য দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ

তিনি আরও বলেন, ‘দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের তাৎক্ষণিক অভিযানের মাধ্যমে অনেক দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিতর্কিত নিয়োগ বন্ধ করা, নিম্নমানের নির্মাণকাজ বন্ধ করা, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, নদী-খাল ও সড়কের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও পরিবেশ রক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’

অভিযোগ দায়ের ও কার্যক্রম নিয়ে দুদক তার কাজে সন্তুষ্ট হলেও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর দুদক নিয়ে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়, দুর্নীতির অভিযোগে সাড়া প্রদানের ক্ষেত্রে দুদকের ঘাটতি রয়েছে। তাছাড়া অভিযোগ দায়েরের পরিমাণের তুলনায় মামলা দায়েরের হার কম। নারী ও দরিদ্রসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ চাহিদা মেটানোরও কোনও কাঠামো নেই। সার্বিকভাবে দুদকের কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ জনগণের ধারণা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।

আগামীকাল বৃহস্পতিবার পড়ুন:

দুদকের ভেতর-বাহির ৪: একদিকে সক্ষমতা বাড়ানোর তৎপরতা, অন্যদিকে খর্ব করার আইন!

আরও পড়ুন:

নতুন আয়কর আইনেও ক্ষমতা খর্ব দুদকের

পাচার হওয়া অর্থ পুনরুদ্ধারে যা করতে চায় দুদক