অরিত্রীর মৃত্যুর ৫ বছর

‘সন্তানের লাশ যে বাবা কাঁধে নেন তিনিই বোঝেন হারানোর বেদনা’

‘সন্তানের লাশের বোঝা যে বাবা কাঁধে নেন তিনিই বোঝেন সন্তান হারানোর বেদনা। এই কষ্ট আমৃত্যু শেষ হবে না। আর এটা হওয়ারও নয়। তারপরও নিজের জন্য, সংসারের জন্য বেঁচে আছি। সন্তান হারানো এতটা কঠিন, কষ্টের; যা শেয়ার করা যায় না। যতদিন বাঁচি, এই বেদনা বয়ে যেতে হবে। সেই দিনের অপমান কখনও ভুলবো না। মা-বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে’— আবেগঘন কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী।

২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর বাবা-মাকে ডেকে শিক্ষকরা ‘অপমান করলে’ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী। আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচণার অভিযোগ এনে তার বাবা দিলীপ অধিকারী রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন।

২০১৯ সালের ২০ মার্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক কাজী কামরুল ইসলাম ওই দুই আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শ্রেণিশিক্ষিকা হাসনা হেনাকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন তিনি। ২০১৯ সালের ১০ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা (তৎকালীন) জজ রবিউল আলম।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ-১২ এর বিচারক আব্দুল্লাহ আল মামুনের আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। চলতি বছরের ২৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত আগামী ২১ জানুয়ারি রায়ের তারিখ ধার্য করেছেন।

জানতে চাইলে অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তারা (শ্রেণি শিক্ষিকা) সেদিন সন্তানের সামনে আমাদের সঙ্গে এ ধরনের ব্যবহার না করলেও পারতেন। বাবা-মায়ের অপমান কোনও সন্তান সহ্য করতে পারে না। টিসি দিয়ে বের করার হুমকি দেয়। যাদের কারণে সন্তান হারিয়েছি, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। সন্তান হারানোর বিচার চেয়ে মামলা করেছি, লড়েছি। এখন বিচার যা হয়, মেনে নিতে হবে। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা চাই। তবে সেদিন তাদের ব্যবহার ছিল কমার্শিয়াল, ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বারবার বলেছি টিসি দিয়েন না, সন্তানদের অন্যত্র নিয়ে যাবো। তারা কোনও কথাই শোনেনি। বললো মোবাইল দেখে নকল করেছে। কিন্তু তারা তা প্রমাণ করতে পারেনি।

অরিত্রীর ছোট বোন ঐন্দ্রিলা অধিকারীর বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ও এখন আমাদের সব। চোখের আড়াল করি না। মেয়েটা কিছুটা অভিমান করে। বোন মারা যাওয়ায় বড় ভুক্তভোগী সে। বড় বোনই ছিল ওর সব। সে এখন বোনের মতো সাজতে চায়। বোনই তার কাছে আইডল। এখন মা-বাবার টেককেয়ার করে সে। আমাদের সান্ত্বনা দেয়। প্রতিটি জায়গায় আমার বড় মেয়ের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ওর ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখনও কিছু বাসায় আছে। কিছু গরিবদের দিয়ে দিয়েছি। গিটারটা আগের জায়গাতেই রয়েছে।’

অরিত্রীর মায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখনও সে দিনে দুয়েক বার কান্নাকাটি করে। মেয়ের বান্ধবীরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওর মা কাউকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দেখলে, আবেগ ধরে রাখতে পারে না, মেয়ের কথা মনে করে খুব কষ্ট পায়। বছর ঘুরে মেয়ের মৃত্যুর দিনটি সামনে এলে— অরিত্রী খেতে পছন্দ করতো এমন খাবার রান্না করে। সেই খাবার গরিব-দুঃখীদের খেতে দেন তার মা।’

মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছি। প্রতিটি সাক্ষী আসামিদের বিরুদ্ধে গেছে। আশা করছি, আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হবে এবং ভুক্তভোগী পরিবারটি ন্যায়বিচার পাবে।

এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, দুই আসামির বিরুদ্ধে যে ধারায় চার্জ গঠন করা হয়েছে তার অভিযোগ প্রমাণিত হলে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। 

মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর পরীক্ষা চলাকালে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পান দায়িত্বরত শিক্ষক। মোবাইল ফোনে নকল করেছে এমন অভিযোগে অরিত্রীর মা-বাবাকে নিয়ে স্কুলে যেতে বলা হয়। দিলীপ অধিকারী তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে স্কুলে গেলে ভাইস প্রিন্সিপাল তাদের অপমান করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। অধ্যক্ষের কক্ষে গেলে তিনিও একই রকম আচরণ করেন। এ সময় অরিত্রী দ্রুত অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। পরে শান্তিনগরে বাসায় গিয়ে তিনি দেখেন, অরিত্রী তার কক্ষে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছে। ওই ঘটনার পরদিন পল্টন থানায় তার বাবা দিলীপ অধিকারী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।

অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্কুল কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় স্কুলের অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১০ জুলাই চার্জগঠন করে বিচার শুরু আদেশ দেন আদালত। বর্তমানে ওই শিক্ষিকা জামিনে রয়েছেন।

বিচার চলাকালে মামলাটিতে ১৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করেছেন আদালত।