দেশভাগের পর টাঙ্গাইল থেকে আমার ঠাকুরদা আসছেন এখানে। সে সময় অনেক সনাতন ধর্মের তাঁতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। আমার বাবার বয়স তখন ৯ বছর। এখানে এসেই তিনি তাঁত ধরেছিলেন। নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলে আমার স্বজনদের বাস। টাঙ্গাইল থেকে যারা এসেছিলেন, তারা যে তাঁত বুনতেন—সেটাই এখানেও ‘টাঙ্গাইল’ নাম হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলে হয় যে শাড়ি সেটার জন্য না, সেখানকার তাঁতিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে সেটাকে ধরে রেখেছে বলে এর নাম টাঙ্গাইল। তবে এখন আর সেই টাঙ্গাইলের তাঁতও খুব বেশি না, এখন তাঁতের চেয়ে পাওয়ার লুমে আগ্রহ বেশি। টাঙ্গাইলের শাড়ি কখনোই আমাদের না। ওটা বাংলাদেশের। আমরা নামটা ব্যবহার করি।
কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ায় বসবাসরত তাঁতি দীপক বসাক। তার জন্মও পশ্চিমবঙ্গে।
টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিটি) ভারত নিয়ে নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এরপরই কথা হয় সেই তাঁতিদের সঙ্গে, যারা কিনা এই শাড়িগুলো বুনেন এবং পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ হিসেবে বিক্রি হয়। কী হলো বিষয়টা প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার (ফুলিয়ার) আরেক তাঁতি বলেন, কিছু শব্দগত ব্যবহারের ভুল হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই তাঁত আমার বাপঠাকুরদার। বংশ পরম্পরায় আমরা এই শাড়িটা বুনি। এই শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো—এটা তাঁতে হয় এবং পলিশ করা থাকে। এটা এই বাংলায় বোনা টাঙ্গাইল।’
মনিকা বসাক বলেন, ‘এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জিনিস। আমরা এখানে নামটা ব্যবহার করি। কারণ, আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা ওখান থেকেই তাঁতটা এখানে এনেছেন।’
জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০২০ সালে আবেদন করে পশ্চিমবঙ্গের তন্তুবায়ী সমবায় সমিতি। পর্যবেক্ষণের নানা ধাপ পেরিয়ে গত ২ জানুয়ারি এর স্বীকৃতি দেয় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগ। তাতে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা নিয়ে কিছুই জানেন না খোদ তাঁতিরা, যারা মূলত বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে গিয়ে নদীয়া ও শান্তিপুরে এই কাজটিকে ধরে রেখেছেন। আবার শাড়িটির ভৌগোলিক নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে বলা হয়েছে—এর নাম ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’। যারা শাড়ি নিয়ে কাজ করেন তারা বলছেন, শান্তিপুর ডিজাইন ও ঢাকাই টাঙ্গাইলের সংমিশ্রণে এক ধরনের সংকর শাড়িকে ‘টাঙ্গাইল’ নাম দিয়ে জিআই প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা এক ধরনের অসততা।
ফুলিয়ার তাঁতিরা বলছেন, এখন টাঙ্গাইল শাড়ি বানাতে তারা আগ্রহ পান না। কিন্তু বাজারে টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়—অনেক বড় বড় শাড়ির দোকান সরাসরি বাংলাদেশ থেকে বোনা শাড়ি নিয়ে আসে। সেসবের অনেকটাই ফুলিয়া বলে বিক্রি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলেরই। কোন তাঁতি কোন পরিস্থিতিতে কোন দেশে আশ্রয় নিলেন, সেটা এখানে বড় বিষয় না। এখানে আমাদের তাঁত বোর্ডের কিছু উদাসীনতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। এর আগে জামদানি নিয়ে যখন ভারত এমন করলো, আমরা তখনই টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। গত তিন বছরে সেটা হয়নি বলে ভারত এটাকে নিজেদের দাবি করতে পারলো। তবে এখনও অসুবিধা নেই। রিভিউ করার সুযোগ আছে। সেটা দায়িত্বশীলরা যত গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত করবেন, ততই ভালো।’