‘বই খাতা পড়ার টেবিল সব আগের মতোই আছে, শুধু সানি নেই’

ঈদ আসে আর ঈদ যায়। সবার বাসায় ঈদের আনন্দ থাকে। কিন্তু আমাদের বাসায় ঈদের কোনও আনন্দ নেই। এমনকি ভালো খাবারও রান্না করা হয় না। পরিবারের সব আনন্দ যেন ছোট ভাই সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী তারিকুজ্জামান সানি ২০২২ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন মৈনট ঘাটে ১৫ জন বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ হয়। পরদিন বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে ঘাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় সানির বড় ভাই হাসাদুজ্জামান বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

সানিকে হত্যা করা হয়েছে, নাকি সে দুর্ঘটনায় মারা গেছে তা প্রায় দুই বছরেও জানা যায়নি। তবে আসামিপক্ষের স্বজনরা বলছেন, এটা হত্যা নয়, নিছক দুর্ঘটনা। ভিকটিমের পরিবার পরিকল্পিত হত্যা বলে অভিযোগ করছে। পুলিশ বলছে, মামলার তদন্ত শেষে উদঘাটন হবে প্রকৃত রহস্য।

বর্তমানে মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য রয়েছে। সর্বশেষ গত ৭ মার্চ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। ফলে ঢাকার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম সাইফুল ইসলামের আদালত আগামী ২৭ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। এখন পর্যন্ত ১৭ বারের মতো মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

নিহত সানির স্মৃতিচারণ করে তার বড় ভাই হাসানুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ৪ বছর আগে বাবাকে হারিয়েছি। সেই শোক কাটতে না কাটতে ভাইটাকেও হারালাম। সানির মৃত্যুর পর থেকে মা খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। সানি যে খাবারগুলো খেতে পছন্দ করতো, সেগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতি এক ঘণ্টা পর পর ছোট ভাইয়ের কথা স্মরণ করে আর কান্নাকাটি করে। ঈদ আসে আর ঈদ যায়, সবার বাসায় ঈদের আনন্দ থাকে, আমাদের বাসায় কোনও আনন্দ নেই। এমনকি ভালো খাবারও রান্না করা হয় না। ঈদের দিনে কেউ যদি জোর করে খাবার দিয়ে যায় তখন বাধ্য হয়ে খেতে হয়। প্রয়োজন ছাড়া নতুন কোনও পোশাকও কেনা হয় না। পরিবারের সব আনন্দ যেন সানি সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। পরিবার বলতে আমি আর মা। যে কয়দিন বেঁচে থাকবো, এভাবেই চলবো।

তিনি আরও বলেন, মা মাঝে মধ্যে সানির রুমে গিয়ে ড্রয়ারে থাকা কাপড়চোপড় হাতে নিয়ে কেঁদে ওঠেন। তার ছবি নিয়ে বসে থাকেন। এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি। যার যায় সে বুঝে। আমার ছোট ভাই সানি খুব আদরের ছিল। আমাদের স্বপ্ন ছিল। সে আমাদের জন্য কিছু করবে তা নয়, বরং তার জন্য আমরা কিছু করতে পারিনি ভেবেই কষ্ট লাগে।

হাসানুজ্জামান বলেন, সানির বই খাতা পড়ার টেবিল সব আগের মতোই আছে, শুধু সে নেই। জিনিসপত্র দেখে মনে হয় সানি ছিল, এখন আর নেই। তবে সানির মৃত্যুর বিষয়টা সন্দেহজনক। কয়েকজন বলেছে সানিকে খেয়াল করেনি। আবার কয়েকজন বলছে, সানি পড়ে গেলে তাকে তারা সাহায্য করতে যায়। তারা চাইলেই সানিকে বাঁচাতে পারতো। আমাদের একটাই চাওয়া প্রকৃতি অপরাধীরা যেন মুক্তি না পায়, আর নিরাপরাধ কারও যেন সাজা না হয়।

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা কুতুবপুর নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির এসআই (নি:) জহিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তদন্ত চলমান রয়েছে। এর বাহিরে আমার কোনও মন্তব্য নেই। অগ্রগতি সম্পর্ক জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানান এই তদন্তকারী কর্মকর্তা।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী প্রণব কুমার দে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে দোহার এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিল। ওই ছেলেটা (সানি) কখন পা পিছলে পড়ে যায় অন্য বন্ধুরা কেউ জানতো না। যখন অন্য বন্ধুরা জানতে পেরেছে তাদের মধ্যে একজন নেই, তখন সঙ্গে সঙ্গে খোঁজার চেষ্টা করেছে। ফায়ার ব্রিগেডে গিয়েছে, থানায় গিয়েছে। বেসিক্যালি ছেলেগুলো একেবারে ইনোসেন্ট। তারা থানায় গিয়েছে, ফায়ার ব্রিগেডে গেছে খোঁজ করতে। তারা যদি অপরাধ করতো তাহলে থানায় যেত না। আমি সব আসামির সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ভিকটিম কখন পড়ে গেছে তারা কেউ জানতো না। এই মামলায় সব আসামি খালাস পাবেন বলে আশা এই আইনজীবীর।

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা জেলার দোহার থানাধীন মৈনট ঘাটে ১৫ বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে নিখোঁজ হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী তারিকুজ্জামান সানি। নিখোঁজ হওয়ার পর সানির সন্ধানে নামে ফায়ার সার্ভিস সদর দফতর থেকে ডুবুরি দল। ওইদিন রাতে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরদিন বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে মৈনট ঘাট থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সে দিন বিকালে সানির বড় ভাই হাসানুজ্জামান একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় আসামি করা হয় সানির সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া ১৫ বন্ধুকে। তারা হলো-শরীফুল হোসেন, শাকিল আহম্মেদ, সেজান আহম্মেদ, রুবেল, সজীব, নুরজামান, নাসির, মারুফ, আশরাফুল আলম, জাহাঙ্গীর হোসেন লিটন, নোমান, জাহিদ, এটিএম শাহরিয়ার মোমিন, মারুফুল হক মারুফ ও রোকনুজ্জামান ওরফে জিতু। আসামিরা বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়েছে।