এ বছরই হাইকোর্টে শেষ হচ্ছে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের শুনানি

সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ছাত্রী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। যৌন হয়রানির অভিযোগে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই শিক্ষার্থীকে। তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। ওই ঘটনায় করা মামলাটি বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হলেও ঝুলে আছে হাইকোর্টের বিচার (ডেথ রেফারেন্স ও আপিল)। তবে চলতি বছরেই আলোচিত এ মামলার রায় হওয়া নিয়ে প্রত্যাশা জানিয়েছেন আইনজীবীরা।

মামলার বিবরণী থেকে জানা গেছে, সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার উচ্চ মাধ্যমিক শাখার ছাত্রী ছিলেন নুসরাত জাহান রাফি। ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ তাকে নিজের অফিসে ডেকে নিয়ে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে। পরে রাফি বিষয়টি পুলিশকে জানায়। এরপর ৬ এপ্রিল রাফির মা বাদী হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা করলে পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে। পরে আদালত তার জামিন আবেদন বাতিল করে কারাগারে পাঠায়।

‘এরপর থেকে রাফি ও তার পরিবারকে মামলা প্রত্যাহার করার চাপ দিতে থাকে অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা। যার ধারাবাহিকতায় রাফি পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে তাকে মিথ্যা কথা বলে একটি ভবনের ছাদে নেওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরা পাঁচ ব্যক্তি প্রথমে মামলা তোলার জন্য একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলে।’

রাফি অস্বীকৃতি জানালে ওই পাঁচ হত্যাকারী প্রথমে রাফিকে হাত-পা বেঁধে মুখ চেপে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। হত্যাকারীদের তিনজন পুরুষ এবং দুইজন নারী। অগ্নিদগ্ধ রাফি ছাদ থেকে নিচে পালিয়ে আসে। তবে তার শরীরের ৮০ শতাংশ পুড়ে যায় বলে চিকিৎসকেরা জানান। ফেনী হাসপাতালে অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে ১০ এপ্রিল রাতে চিকিৎসাধীন রাফি মারা যায়।

পরে অগ্নিসন্ত্রাসের ওই ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলার রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যার দায়ে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

তারা হলো- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলার রায়সহ সব নথি হাইকোর্টে আসে। এরপর মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত শেষে ২০২০ সালের ২ মার্চ আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি। এরই মধ্যে নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত সব আসামি আপিল দায়ের করে। ফলে দীর্ঘদিন ধরে শুনানির অপেক্ষায় ঝুলে যায় মামলাটির কার্যক্রম।

তবে দীর্ঘ সময় পর হলেও মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নুসরাত হত্যা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়েছে। বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলাটির আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে। প্রধান বিচারপতি সালের ক্রম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো বিভিন্ন বেঞ্চে নিষ্পত্তির জন্য পাঠাচ্ছেন। সে অনুযায়ী শুনানি হচ্ছে।

আসামিদের অন্যতম আইনজীবী জামিউল হক ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই মামলাটিতে বিচারিক আদালতে একপ্রকার মিডিয়া ট্রায়াল হয়েছে। যার করণে আসামিরা ন্যায়বিচার বঞ্চিত হয়েছে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। মামলাটি কার্যতালিকায় আছে। আশা করছি আসন্ন রমজানের ঈদের পর হাইকোর্ট খুললে (অবকাশ শেষে) আমরা মামলাটির শুনানি শেষ করতে পারবো এবং আসামিদের পক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সফল হবো।