ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না

দ্বিতীয় দফার হিট অ্যালার্ট চলছে। রাজধানী থেকে বিভাগীয় শহরে। এখন সব আলাপ গিয়ে ঠেকেছে গরমে। কেন এত গরম। কী করলে কমবে এই অসহনীয় গরম। সেই আলাপে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত হয়ে  ‘গাছ লাগানোর’ প্রয়োজনীয়তা নিয়ে পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। চলছে তর্ক-বিতর্ক। আসছে নানা সংগঠন থেকে হাজার থেকে শুরু করে লাখো সংখ্যায় গাছ লাগানোর ঘোষণা। সেসব ঘোষণাদাতাকে সতর্ক করে দিতে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলছেন—গাছ লাগাতে চাওয়া ভালো, কিন্তু তার আগে গাছ লাগানোর মৌসুমটা জেনে নিন।

এবারের গরমে সবচেয়ে আলাপের বিষয়—দেশে গাছ কমে যাওয়ায় গরম বেড়েছে। যদিও এটাই একমাত্র কারণ নয়, বলছেন পরিবেশবিদরা। ভুল গাছ লাগানো, বড় গাছের জায়গা ঝোপঝাড় দিয়ে পূরণ করা, জলবায়ু পরিবর্তন সবকিছু মিলিয়ে তাপ বেড়েছে।

রমনা পার্ক, ছবি: সাজ্জাদ হোসেন২০২৩ সালে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের সময় ৩০টি তালগাছ উপড়ে ফেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন—‘একটি গাছ কাটলে ১০টি গাছ লাগাতে হবে। জনস্বার্থে একান্ত প্রয়োজন হলে অনুমতি নিয়ে দু-একটি গাছ অপসারণ করা যাবে। তবে কাটার আগে গাছ লাগাতে হবে।’

উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশ কেউ মানেনি। সেই নির্দেশ কেবল ওই ঘটনায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না। আইনজ্ঞরা বলছেন, এটা সার্বিক নির্দেশ হিসেবে দেখতে হবে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বিশেষত ঢাকায় বাংলাদেশের সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে গাছ কেটে ফেলার অভিযোগ পুরনো। কেউ গাছ কাটে, মাথা মুড়িয়ে দেয়, আবার কেউ গাছ লাগায়। যারা গাছ লাগায়, তাদের সবার মধ্যেও সমান আন্তরিকতা নেই—অভিযোগ ‍তুলে পরিবেশবাদীরা বলছেন, বড় গাছ কেটে, বাগানবিলাসের মতো ঝোপ তৈরি করলে সেটা কাজের হয় না।

চলতি মাসে ১৬ এপ্রিলের পর গরম বাড়তে থাকলে ২১ এপ্রিল থেকে ঘোষণা দিয়ে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পানির সোর্স না থাকা, বড় গাছ না থাকার পরিস্থিতি থেকে বের হতে গাছ লাগানোর কথা উঠছে। এরইমধ্যে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কয়েক লাখ গাছ লাগানোর ঘোষণা দিয়েছে।

বর্ষা মৌসুমে গাছ লাগানোর কথা যেন কেউ ভুলে না যান, সে বিষয়ে ফেসবুকে পোস্টউল্লেখ্য, কয়েক দশক আগেও পৃথিবীর মোট স্থলভূমির ৩১ শতাংশ ছিল বন। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ বা ডব্লিউডব্লিউএলের মতে, প্রতি বছর এক কোটি ৮০ লাখ একর জমির গাছ উজাড় হচ্ছে। প্রতি মিনিটে ২৭টি ফুটবল মাঠের সমপরিমাণ জায়গা থেকে গাছ নাই হয়ে যাচ্ছে। গত ৫০ বছরে আমাজনের মতো জঙ্গলে ১৭ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটি করুণ, কিন্তু স্পষ্ট নয়।

নগর পরিকল্পনাবিদ আখতার হোসেইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যখন কোনও প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তখন যদি নগর পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে যথাযথ ব্যক্তির পরামর্শক্রমে কাজগুলো করা যায়—তাহলে বিষয়গুলো এরকম হাতছাড়া হয়ে যায় না। গাছ কাটতে কাটতে নাই হয়ে যাওয়ার পরে হাহুতাশ করে কী লাভ! এখন গাছ লাগালে সেটার সুফল ভোগ করতে আগামী ১৫/২০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাই বলে গাছ লাগাবেন না, তা নয়। সঠিক সময় জেনে ঠিক গাছটি লাগানো দরকার।’

নানা উদ্যোগের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরা হয়আমরা জানি না এখন গাছ লাগানো মৌসুম কিনা, আমরা জানি না, এ গাছ বাঁচবে কিনা। তাহলে সঠিক সময়টা কখন প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সুজা উদ-দৌলা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গাছ লাগানোর প্রকৃত সময় জুন থেকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি। এখন যদি গাছ লাগানো হয়, সেটা বাঁচানো যাবে না। ফলে গাছ কোথায় কোনটা লাগাবেন, সেটার পরিকল্পনা করে করতে হবে। একাশিয়া, ফার্ন, হস্তা, পামসহ আমরা যেগুলোকে অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট বলি, সেগুলোর মধ্যে কোনগুলো আসলে শহরে লাগাবেন, সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ কোন গাছ আপনাকে ছায়া দেবে—সেসব নিয়ে বিস্তর জানাশোনা মানুষ আছে। তাদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।’

আছে স্যাটায়ারধর্মী পোস্টওভুল গাছ কোনগুলো জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘একাশিয়া, ইপিল ইউক্যালিপটাস এখন আঁকছে আমাদের দিগন্তরেখা। এগুলো ভুল গাছ।’ তিনি বলেন, ‘গরম কমানোর বিষয়ে সব চিন্তা গাছকেন্দ্রিক হলে হবে না। খোদ ঢাকা শহরেই এলাকা ভিত্তিতে তাপমাত্রার রকমফের ঘটছে গাছ আর জলাধারের অবস্থান আর ব্যবস্থাপনার জন্য। সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন আর এয়ারকুলার ছাড়া কেউ অন্য কিছু ভাবতে পারছে না। সূর্যের তাপমাত্রার সঙ্গে যোগ হচ্ছে এসব ঠান্ডা রাখার মেশিনের তাপ।’