কার কারণে খাল পরিণত হচ্ছে ময়লার ভাগাড়ে?

‘এক সময় আমার বাড়ির পাশ ঘেঁষে ছিল কাজলা খালের অবস্থান। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় আমরা খাল পার হতাম। ছোটবেলায় এই খালে কত যে সাঁতার কেটেছি তার হিসাব নেই। কত বড় খাল আজ কী হয়ে গেলো! এখন খালটির দিকে তাকালে কষ্ট হয়। এই খাল শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে যুক্ত। এ নদী আবার যুক্ত ছিল বুড়িগঙ্গার সঙ্গে। পণ্য বোঝাই ট্রলার বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যা হয়ে কাজলা পাড়ে আসতো। এখন এটা খাল নয়, যেন ময়লার ভাগাড়!’

আশির দশকের স্মৃতিচারণ করে এভাবেই বাংলা ট্রিবিউনকে কথাগুলো বলছিলেন কাজলা পাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় এই খাল পাড়ি দিতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসতো। অনেক চওড়া ছিল খাল। কিন্তু এখন দুই পাশের দখলের কারণে সরু হয়ে গেছে। এখানে আগে নিয়মিত জোয়ার-ভাটা হতো। এখন ঠিকমতো পানিই  প্রবাহিত হয় না। ময়লা-আবর্জনার কারণে পানি নড়ে না। আশেপাশের সব খালের অবস্থা একই। কুতুবখালী, কাজলা, শ্যামপুর খাল সব এখন দখলের কারণে সরু হয়ে গেছে। এ সব খাল রক্ষায় কারও কোনও উদ্যোগ দেখছি না।’

যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কুতুবখালী, কাজলা, মৃধা বাড়ি ও শ্যামপুর খালের কিছু অংশ ঘুরে দেখা যায়, খালের মধ্যে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। চিপস-বিস্কুটের প্যাকেট, বাঁশের চাটাই, চিকিৎসার বর্জ্য, ভাঙা টিভি, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, লেপ-তোশক, ছেঁড়া জুতা, পুরোনো জামাকাপড়, টায়ার, ফুলের টব, ছেঁড়া ব্যাগসহ প্লাস্টিকের নানা পণ্যের ঠাঁই মিলেছে খালে। মানুষের অপ্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্রের কারখানা হিসেবে গড়ে উঠেছে এ সব খাল। অনেক জায়গায় সাইনবোর্ড দেওয়া আছে ‘খালে ময়লা ফেলবেন না, যারা ময়লা ফেলবেন তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।

কিন্তু কে শোনে কার কথা! সাইনবোর্ডের দিকে তাকানোর সময় কারও নেই। অবলীলায় খালের ধারে ময়লা ফেলে যাচ্ছেন সবাই। শুধু ময়লা-আবর্জনাতে খালগুলো পরিপূর্ণ হচ্ছে তা নয়, দখলদারদের দখলদারিত্বেও খালের সর্বনাশ হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ধোলাইপাড় থেকে যাত্রাবাড়ীর মূল সড়ক পর্যন্ত কুতুবখালী খালের দুই পাশে ময়লা-আবর্জনার ছোট-বড় স্তূপ। ধোলাইপাড়ের শুরুতে যে খালের প্রশস্ততা অন্তত ২০-২২ ফুট, কিছু দূর না যেতেই তা ক্রমান্বয়ে ১৫ থেকে ১০ ফিট হতে থাকে। একটু দূরে এগোতেই খালের পরিধি আরও ছোট হয়ে আসে। কাজলা খালেরও একই অবস্থা। শুরুতে এই খাল প্রায় ৩০ ফুট প্রশস্ত হলেও কিছুদূর না যেতে অর্ধেকে নেমে আসে এর ব্যাপ্তি। মৃধা বাড়ি খালে ময়লাযুক্ত পানি থইথই করলেও শ্যামপুর খাল দেখতে প্রায় মৃত।

যাত্রাবাড়ীর কাছে কাজলা খাল যেন আবর্জনার ভাগাড়

কুতুবখালী মাদ্রাসা রোডের মোক্তার হার্ডওয়্যার স্টোরের সামনে এক ব্যবসায়ীকে ময়লা ফেলতে দেখেন বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদক। খালে ময়লা ফেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির কারণে সিটি করপোরেশনের লোকেরা ময়লা নিতে আসেনি। দুদিন আগে আমার দোকানের সামনে কাঁচাবাজার বসেছে। সেসব ময়লা জমে দোকানের সামনে গন্ধ ছড়াচ্ছে। তাই সবকিছু একসঙ্গে করে খালে ফেলছি।’

কিন্তু ময়লার স্তূপে বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল ছিল। এসব কেন খালে ফেলছেন– প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কখনও খালে ফেলি না। আজ ময়লা নেওয়ার লোক আসে নাই, এজন্য এখন খালে ফেলছি। আর খালে ফেললে পানির স্রোতে চলে যাবে। এখানকার সবাই তাদের দোকানের ময়লা খালের পাশে ফেলে দেয়।’

দক্ষিণ কুতুবখালীর বাসিন্দা সৈয়দ নাসির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কুতুবখালী খাল আরও চওড়া ছিল। দখলের কারণে এর প্রস্থে এখন ঠিকঠাক ১০ হাত জায়গায়ও নাই। অথচ এক সময় এই খাল এখনকার চেয়ে দ্বিগুণ চওড়া ছিল। অনেক আগে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ অভিযানও চালিয়েছে। এখন আর কোনও খোঁজ-খবর নাই। খাল সরু হয়ে যাওয়ার কারণে যখন পানি বেড়ে যায়, তখন নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি চলাচল করতে পারে না। এ জন্য রাস্তাঘাট ডুবে যায়।’

কাজলার বাসিন্দা আবু তাহের বলেন, ‘এক বছরও হয় নাই খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আবার ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।’

করপোরেশনের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোকেরা ঠিকমতো রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করে না। তারা নিজেরাই খালে ময়লা ফেলে। খালের পাড়ে পড়ে থাকা ময়লা গাড়িতে না তুলে খালের দিকে আরেকটু ঠেলে দেয়। মানুষের সচেতনতার অভাবে এই খালের এখন মরার মতো অবস্থা। ঠিকমতো পানি চলাচল করতে পারে না।’ এছাড়া খালের দুই পাশ দখল হয়ে যাওয়ার কথাও বলেন এই বাসিন্দা।

এমন হেন ময়লা নেই যা খালে নেই

অবশ্য এর আগেও কাজলা খাল দখলমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বলে জানান স্থানীয়রা। তখন সীমানাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে সিটি করপোরেশন আর কোনও কাজ না করায় আবারও দখল হয়ে গেছে খালপাড়। শুধু কাজলা নয়, আশেপাশের খালগুলোরও একই অবস্থা। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে খালের অনেকাংশ।

যাত্রাবাড়ী কাজলাপাড়ের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অনেক বছর আগে খাল উদ্ধারের জন্য এক পাশের সব বাড়ি-ঘর ভেঙে ফেলে সিটি করপোরেশন। তখন ভেবেছিলাম এই খালের আধুনিকায়ন হবে, কিন্তু হয়নি।’

খালে ময়লা ফেলার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাসুম মোল্লা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালে ময়লা না ফেলতে মানুষকে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে অনুরোধ করছি। নামাজ শেষে মসজিদের মাইকে মুসল্লিদের বলা হয়। কিন্তু কেউ কথা শোনে না। সবাই খালে ময়লা ফেলে। বেশিরভাগ মাদ্রাসা আর দোকানপাটের ময়লা খালে আসে। গৃহস্থালি বা বাসা-বাড়ির ময়লা প্রতিদিন সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে নিয়ে যায়। যত্রতত্র বর্জ্য ফেলার কারণে এখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। খাল দিয়ে পর্যন্ত ঠিকভাবে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এ জন্য অল্প বৃষ্টি হলে খালের ওপর দিয়ে পানি উঠে রাস্তা ডুবে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘জনগণ সচেতন না হলে সিটি করপোরেশন যতই ময়লা পরিষ্কার করুক লাভ হবে না। ঘুরেফিরে খাল আবারও ময়লার স্তূপে পরিণত হবে। আমাদের দিক থেকে আমরা জনগণকে সর্বোচ্চ সচেতন করার চেষ্টা করছি।’

এদিকে খালকে দূষণমুক্ত রাখতে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন নগরবিদরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আবর্জনা ফেলা বন্ধে নগরবাসীর মাঝে সচেতন সৃষ্টি প্রয়োজন। মানুষের সচেতনতা ছাড়া স্থায়ীভাবে খালে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা যাবে না। দিন শেষে মানুষের ফেলা ময়লা-আবর্জনাতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষকেই ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়।’

আবর্জনায় রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে খালের গতিপথ

দখল হয়ে যাওয়া খালের বিষয়ে এই পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘একটা সময় ঢাকা শহরে অনেক খাল ছিল। প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বের কারণে এখন অনেক খালের নাম-গন্ধও নেই। রাজধানীকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে সিটি করপোরেশনের উচিত দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার করা। এতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার যে সমস্যা সেটি নিরসন হবে।’

খাল পরিষ্কারের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছর কাজলা, শ্যামপুরসহ ৯টি খালের ময়লা পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এখন আবার আবর্জনায় ভরে গেছে। কারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ময়লা-আবর্জনা খালে ফেলে। এ কারণে কিছুদিন আগের বৃষ্টিতে ওই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নগরবাসীর মাঝে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জনগণ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজে সচেতন না হবে, ততক্ষণ কোনও শাস্তি দিয়ে বা নিয়ম করে জনসচেতনতা তৈরি সম্ভব না। সিটি করপোরেশন ইতোমধ্যে চারটি খালের পাড়ে সবুজায়ন ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, যা ২০২৭ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে। এভাবে ধীরে ধীরে সবগুলো খাল পরিষ্কার করে আধুনিকায়ন করা গেলে সাধারণ মানুষ চাইলেও সেখানে আর ময়লা ফেলতে পারবে না।’

আরও পড়ুন-

রামচন্দ্রপুর খালের বিলীন যে অংশের চিহ্ন রয়ে গেছে এখনও

ময়লা সরালেও আবার আগের চেহারায় ফিরে যায় খাল

খালের সীমানা নির্ধারণে কতটা এগোলো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন?

খালে এসব কে ফেলে, কেন ফেলে?

কল্যাণপুরে হবে ‘হাইড্রো ইকোপার্ক’, কমবে জলাবদ্ধতা বাড়বে সৌন্দর্য

সুতিভোলা খাল উদ্ধারে তৎপর ডিএনসিসি, ‘বাধা’ স্থানীয়রা

সাদিক এগ্রোর জায়গায় বিনোদন পার্ক করবে ডিএনসিসি